ছবি: আপন দেশ
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যে যে পরিমাণ পুষ্টিগুণ থাকে, তা শরীরের চাহিদা পূরণে অনেক সময়ই যথেষ্ট নয়। ফলস্বরূপ, ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতিজনিত ‘লুকানো ক্ষুধা’ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) ২০২৪- এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। এতে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১১ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকিতে এবং ২৩ দশমিক ৬ শতাংশের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বয়সের তুলনায় যথেষ্ট কম।
তবে আশার আলো দেখিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গবেষকরা। ‘প্লাজমা প্রক্রিয়াকরণের’ (ট্রিটমেন্ট) মাধ্যমে শস্যে খনিজ পদার্থ যোগ করার একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তারা। এ পদ্ধতিতে শস্যকে এক ধরনের প্লাজমা (আয়নিত গ্যাস) ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের (ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদান) সংস্পর্শে আনা হয়। যা শস্যের মধ্যে খনিজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাবের গবেষণায় এটি প্রমাণ হয়েছে। এতে গবেষক হিসেবে ছিলেন রাবির ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের পিএইচডি গবেষক মো. মামুনুর রশিদ এবং সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ও ল্যাব পরিচালক ড. মো. মামুনুর রশিদ তালুকদার। প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগ পদ্ধতির উদ্ভাবকও তিনি।
ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, পদার্থের চারটি অবস্থা থাকে। আমাদের চারপাশের বস্তুগুলো সাধারণত কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। প্লাজমাকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলা হয়। এ অবস্থায় সাধারণত প্রায় সমানসংখ্যক ধনাত্মক চার্জযুক্ত আয়ন ও ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন থাকে। প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহারে দেশের প্রথম এবং একমাত্র গবেষণাগার হলো প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাব। এটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। যেখানে প্লাজমার প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে কাজ করা হয়।
আরও পড়ুন<<>>বুধবার ঘোষণা হবে জকসুর তফসিল
গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, প্লাজমা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ধানে ৫৯ শতাংশ, আলুতে ২০৪ ও বেগুনে স্বাভাবিকের তুলনায় ৮৮ শতাংশ জিংকের পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। ধান ছাড়া গম, ভুট্টা ও সবজিতেও প্লাজমা প্রক্রিয়াকরণ করা যেতে পারে। ইতোপূর্বে দেশের প্রধান কৃষিজ শস্য যেমন ধান, গম, আলু, বেগুন ও পালংশাকে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং রোগবালাই দমনে ভূমিকা রেখেছে।
গবেষণাগুলো সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল জার্নাল অব প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেশন (স্প্রিংগার), হেলিওন (এলসেভার) ও প্লাজমা মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদের দাবি, এ প্রযুক্তি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পুষ্টি ঘাটতি ও ‘লুকানো ক্ষুধা’ মোকাবেলায় বৈপ্লবিক সমাধান হয়ে উঠতে পারে।
এ বিষয়ে গবেষক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘গবেষণাগারে কৃষি ক্ষেত্রে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্লাজমা সোর্স যেমন গ্লাইডিং আর্ক ডিসচার্জ প্লাজমা, ডাইইলেকট্রিক ব্যারিয়ার ডিসচার্জ প্লাজমা, গ্লো ডিসচার্জ প্লাজমা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এ সোর্সগুলো ব্যবহার করে শস্যের বীজ ট্রিটমেন্ট ও প্লাজমা সক্রিয় পানি প্রয়োগের মাধ্যমে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হার, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং রোগবালাই দমন করা গেছে।’
প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগ পদ্ধতির উদ্ভাবন সম্পর্কে ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার বলেন, একক তত্ত্বাবধানে ল্যাব থেকে প্লাজমা টেকনোলজি কৃষি গবেষণায় প্রয়োগের প্রথম সফলতা আসে ২০১৫ সালে। এবার প্রথমবারের মতো খাদ্যে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফোর্টিফিকেশনে প্লাজমার প্রয়োগ ও ফসলের উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে গবেষণায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ফোর্টিফিকেশনে প্লাজমা প্রয়োগের ফলে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি নিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া ধান উৎপাদন সময়ও ১৫-২০ দিন কম লাগে। গবেষণার ফলাফল কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিলেই এটি সার্থক হবে।
তবে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ টেকনোলজি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে যে বাজেট প্রয়োজন তা আমরা পাচ্ছি না। হিট প্রজেক্ট নিয়ে আমরা আশাবাদী ছিলাম, যদিও আমরা তা পাইনি। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ইউজিসি অথবা সরকার আমার এ প্রস্তাবিত প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে যে ধরনের সরঞ্জাম ও বাজেট প্রয়োজন তা অনুমোদন করেন, তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টির মান উন্নয়নে এ প্রযুক্তি একটি টেকসই সমাধান হতে পারে।
আপন দেশ/এসআর/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।




































