ছবি: আপন দেশ
বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এক্সিম, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক মার্জারের আলোচনায় এলেও শেয়ারবাজারে নেমেছে আতঙ্ক।
ঋণের সিংহভাগ খেলাপি হয়ে পড়ায় আস্থা ফেরাতে না পারলে এ উদ্যোগ নতুন সুযোগ নয়, বরং অনিশ্চয়তার ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। রোববার থেকে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন গভর্নর গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এখন সবার দৃষ্টি বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা এ জটিল খেলার পরিণতির দিকে।
শেয়ার বাজারে আতঙ্ক
পাঁচ ব্যাংকই তালিকাভুক্ত হওয়ায় খবরটি শেয়ারবাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনিশ্চয়তায় ভোগা বিনিয়োগকারীরা দ্রুত শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেছেন, ফলে এসব ব্যাংকের শেয়ারদর অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। অথচ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের মার্জারের সিদ্ধান্তকে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে প্রকাশ করা উচিত ছিল।
ঋণ খেলাপির চিত্র ভয়াবহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদমান মূল্যায়ন (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ) প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাঁচ ব্যাংকের ঋণের ৭৭ শতাংশই খেলাপি। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৮ শতাংশের কাছাকাছি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৯৬ শতাংশের বেশি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৯৫ শতাংশ, এসআইবিএল ৬২ শতাংশ এবং তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকা এক্সিম ব্যাংকেও খেলাপির হার প্রায় ৪৮ শতাংশ। এই পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
আরও পড়ুন<<>> ন্যাশনাল লাইফের তদন্তে দুদক: ২১শ’ অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন, ৭১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ-পাচার
ব্যাংকগুলো কী চায়
এক্সিম ব্যাংক: পরিচালনা পর্ষদ একীভূতকরণের বিরোধিতা করছে। তারা মনে করছে স্বতন্ত্রভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া উচিত। তবে বিপুল খেলাপি ঋণ, লোকসানি অবস্থান এবং ধার শোধে ব্যর্থতা একে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: পরিচালনা ব্যয় কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। বোর্ড সভায় ব্যাংকটির অবস্থান নির্ধারিত হবে, যদিও কিছু পরিচালক মার্জারের বিপক্ষে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: একীভূতকরণের পক্ষে সায় দিয়েছে। তাদের চেয়ারম্যানের মতে, মার্জার হলে খাতটিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে।
ইউনিয়ন ব্যাংক: এখনও নিরীক্ষা শেষ হয়নি; আর্থিক প্রতিবেদনও অসম্পূর্ণ।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: উচ্চ খেলাপির চাপে দিশেহারা।
৩৫ হাজার কোটি টাকার চ্যালেঞ্জ
প্রক্রিয়াটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে প্রাথমিকভাবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব করেছে। দীর্ঘমেয়াদে এ ব্যয় দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। সরকার থেকে বিল ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনাও রয়েছে।
তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে- সব দুর্বল ব্যাংক একত্র করে একটি নতুন ব্যাংক তৈরি হবে, নাকি শক্তিশালী ব্যাংকের হাতে আলাদাভাবে তুলে দেয়া হবে? জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এ উদ্যোগ টেকসই হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আস্থা ফেরানোর লড়াই
বাংলাদেশে ব্যাংক একীভূতকরণ নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বেশ কয়েকটি ব্যাংক মিলে গড়ে ওঠে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। সর্বশেষ ২০০৯ সালে শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা একত্র হয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হয়। তবে বেসরকারি খাতে সফল মার্জারের নজির সীমিত।
আরও পড়ুন<<>> সিটি ব্যাংক এমডি মুজিববাদী মাসরুর আরেফিন এখন ব্যাংকখাতের ভয়
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেবল নীতিমালা ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ঘোষণা করলেই বোঝা যাবে এ উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে। ব্যাংক খাতে একের পর এক অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। তাই এ মার্জার কেবল কাঠামোগত পরিবর্তন নয়; এটি আস্থার লড়াইও।
পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক মার্জারের আলোচনাটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য বড় ধরনের পরীক্ষা। এটি যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নতুনভাবে দাঁড় করানোর সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু ব্যর্থ হলে শেয়ারবাজার, আমানতকারী এবং পুরো ব্যাংক খাতের ওপর চাপ আরও বেড়ে যাবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।



































