Apan Desh | আপন দেশ

অপরাধে জড়িত নেতাকর্মীদের শাস্তি কার্যকরে প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক দল

নিজস্ব প্রতিবদেক

প্রকাশিত: ১৮:১৬, ৬ জুলাই ২০২৫

আপডেট: ১৮:২১, ৬ জুলাই ২০২৫

অপরাধে জড়িত নেতাকর্মীদের শাস্তি কার্যকরে প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক দল

প্রতীকী ছবি

দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতার দাপটে নানা অপরাধ করছেন। তারা দখল, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, থানা ভাঙচুর, মামলা বাণিজ্যসহ নানা অপরাধ করে চলেছেন। ক্ষমতার দাপটে অনেকেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত। এতে দলীয় কোন্দল, মারামারি ও সহিংসতা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অপরাধের প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অনেক সময় শোকজ বা সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দেখা গেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এরপর কী হয়? অপরাধ প্রমাণিত হলে তারা কি চূড়ান্তভাবে দল থেকে বাদ পড়েন, নাকি পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন?

অপরাধে জড়িত অনেকে প্রকাশ্যে পুলিশকে গালিগালাজ ও হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি থানা ভাঙচুর করে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে। অনেক সময় রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রশাসনও কঠোর হতে পারছে না।

দলীয় গ্রুপিংয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ বাড়ছে। এতে দলেরই নেতাকর্মীরা আহত বা নিহত হচ্ছেন। একেকটি এলাকায় আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বে রক্তাক্ত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ের এসব ঘটনার প্রভাব পড়ছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপরও।

রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় দফতরে আসছে অসংখ্য অভিযোগ। অভিযোগে উঠে আসছে দলেরই কিছু ‘সুবিধাবাদী’ নেতাকর্মীর নাম, যারা নিজেদের স্বার্থে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে তারা দখল ও মামলা বাণিজ্যে সক্রিয় রয়েছেন। 

নির্বাচন সামনে রেখে দলগুলোর মধ্যে চাপা উদ্বেগ বিরাজ করছে। নেতাকর্মীদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে জনমনে নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি তৈরি হচ্ছে। অনেক নীতিনির্ধারকই মনে করছেন, এসব কর্মকাণ্ড দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। নির্বাচনে ফলাফলেও প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধ করলে দলীয় শাস্তির পাশাপাশি আইনী শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র শোকজ বা সাময়িক বহিষ্কার নয়।

ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, দাবি বিএনপির

দেশের বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল ও মামলা বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানা ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নেন বিএনপির একটি গ্রুপের নেতাকর্মীরা। পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের পর পাথরবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা নেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্ৰ করে থানা ঘেরাও করা হয়। গত ১ জুলাই কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৪৫ জন আহত হন। গত ১১ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এক ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করা নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। চাঁদা না দেয়ায় গত মার্চ মাসে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে টঙ্গীর তুরাগ থানায়। তেমনি বাসস্ট্যান্ড ও টেম্পুস্ট্যান্ড দখল ও হাটবাজার দখলেরও অভিযোগ ওঠে বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের বিরুদ্ধে। তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই দখল, সংঘাত আর চাঁদাবাজির অভিযোগ।

বিএনপির দফতর থেকে জানানো হয়েছে, এ ধরনের ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় তিন হাজার ২০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মী রয়েছেন এক হাজার ৮০০ জন। এদের মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক ও ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়েছে। ছাত্রদল এখন পর্যন্ত  ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ছয় শতাধির নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী বহিষ্কার ও ১৫০ জন কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছেন, যুবদলেরও শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে বহিষ্কারের পরও অনেকেরই দাপট কমেনি। বিএনপি যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের কেউ কেউ আবার দলে ফিরছেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হচ্ছে।

'জিরো টলারেন্স নীতি' বনাম তৃণমূলের বাস্তবতা

বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ দ্রুতই পদপদবী ফিরে পাচ্ছেন, রাজনীতিতেও সক্রিয় আছেন। কিন্তু রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, বিএনপি ও এর নেতারা ‘আপসহীন' ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘একেবারে জিরো টলারেন্স' নীতিতে আছেন। বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য বাস্তব চিত্রের বেশ ফারাক রয়েছে। ‘একেবারে জিরো টলারেন্স' নীতিতেও অনেকে আবার দলে ফিরছেন, সংঘর্ষ-সংঘাতও দেশজুড়েই চলছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই এসব তথ্য উঠে আসছে।

দেশের কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে যাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাদের দাপট কমছে না। যাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে তারা দ্বিগুণ উদ্যোগে মাঠে নেমেছেন। চট্টগ্রামে বহিষ্কৃত হয়ে যারা আবার দলে ফিরেছেন তারাই দাপটের সঙ্গে আছেন বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। বরিশালে বহিষ্কৃত এক নেত্রী এখানো তার নিয়ন্ত্রণ সেখানে বজায় রেখেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা। নাটোরের বড়াই গ্রাম, গাজীপুর, পাবনা ও মানিকগঞ্জ থেকেও পাওয়া গেছে একই তথ্য।

ভোলার এক বিএনপি নেতা বলেছেন, আসলে বিএনপির ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। দখলদার ও চাঁদাবাজরাই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। বাগেরহাটের এক বিএনপি নেতাও এক ধরনের কথা বলেছেন। যারা দখল ও চাঁদাবাহিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত তাদের বহিষ্কার করলেও তাদের আধিপত্য কমছে না।

তারেক রহমান দলীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাশত করা যাবে না। তিনি যত বড় ত্যাগী নেতা হোন, যত মামলা থাকুক কিংবা যতই জেল-জুলুমের শিকার হোন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।

কারণ দর্শানোতেই সীমাবদ্ধ এনসিপি

২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে। এর পর চার মাসে চারজন কেন্দ্রীয় নেতাকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে শোকজ নোটিশ দিয়েছে দলটি। তারা হলেন, গাজী সালাহউদ্দিন তানভীর, আবদুল হান্নান মাসউদ, জোবাইরুল ইসলাম মানিক ও সরোয়ার তুষার। এর বাইরে রাজশাহীর এক নেতা নাহিদুল ইসলামকে দল থেকে সামায়িকভাবে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে।

২০ মে রাতে ধানমন্ডির চার নাম্বার সড়কে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টার অভিযোগে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। পরে এনসিপি নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ তাদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে তাকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে। জবাবে ভুল স্বীকার করেন ও আগামীতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না মর্মে অঙ্গীকার করেন তিনি। এরপর তার কারণ দর্শানো নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয় এনসিপি।

বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য জোবাইরুল ইসলাম মানিক। চট্টগ্রামে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরে একজন মাফিয়াকে হটাতে পারছি। আমাদের বুঝ দিয়ে আবার যদি কেউ মাফিয়া হতে চায়, তাদের বলবো আমাদের চেয়ে বড় মাফিয়া নেই। এ নিয়েও সমালোচনার মুখে ১০ জুন তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি সতর্কবার্তা জারি করে এনসিপি।

এপ্রিলে যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাহউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ ও এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। গত মে মাসে দৈনিক জনকণ্ঠ কার্যালয়ে এক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দলের যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশিরের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে সতর্কবার্তা জারি করে এনসিপি। নিজের দলের এক কেন্দ্রীয় নারী সহকর্মীকে টেলিফোনে আপত্তিকর কথা বলায় শোকজ করা হয় যুগ্ম সদস্যসচিব সারওয়ার তুষারকেও।

২৭ জুন এনসিপির রাজশাহী জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম ওরফে সাজুকে ‘গুরুতর' দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে কেন তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। তিনি দলের আরেক নেতাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, মব তৈরি সহ নানা অভিযোগ আছে।

এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন বলেন, আমরা কাউকেই দল থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করিনি। আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি আছে। তারা অভিযোগের তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে দল তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের দলটি নতুন। আমাদের দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা তৎপর আছি। 

তিনি আরও বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি আলাদা ও স্বতন্ত্র সংগঠন। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। তাদের কাজের দায় আমরা নেব না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, এনসিপি যে বৈষম্যবিরোধীদের দায় নেবে না এটা একটা উদ্ভট কথা। বৈষম্যবিরোধীদের পটিয়া থানা আক্রমণ নিয়ে তো তাদের পক্ষে এনসিপি নেতারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। তাই দায় নেবেন না এটা তারা বলতে পারেন না। আর এনসিপির যে কয়েকজন নেতাকে দল থেকে শোকজ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু তারা চূড়ান্ত কোনো ব্যবস্থা নেননি এখনো। ফলে এটা দায়সারা গোছের  ব্যবস্থা বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। 

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়