
ইসলামী ব্যাংক পিএলসি
দেশের বেসরকারি খাতের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের সুখবর দিয়ে আসছিল। কিন্তু এবারই প্রথম অপ্রত্যাশিত সংবাদ বয়ে আনছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের আভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো ভালো খবর দিতে পারছে না এবার।
খেলাপী ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাওয়ায় এর বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকটি। নগদ টাকার সংকট থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করার অনুমোদন চেয়েছে। তবে তাতেই আপত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, লাভ-লাকসানের সঠিক চিত্র প্রকাশ করতে হবে। ডিভিডেন্ড নীতিমালা অনুযায়ী দিতে পারলে দিবে, নয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিবে না। আটকে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ২০২৪ সালের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন।
গত বছরের হিসাব চূড়ান্ত করতে না পারায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের অনীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনও তৈরি করতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। তাতে গত সাত মাস ধরে ব্যাংকের কোনো চিত্র জানতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংক কিভাবে চলছে তা নিয়ে পুরোটাই অন্ধকারে রয়েছেন তারা। শুধু ইসলামী ব্যাংকই নয়। এমন সমস্যায় পড়েছে আরও ১৭ ব্যাংক।
এদিকে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দেশে না ফেরায় স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার (০১ মে) গভর্নর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সভা শেষ করে।
দফায় দফায় বোর্ড মিটিং
গত ৩০ এপ্রিল ছিল গত ২০২৪ হিসাব বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত ও তার উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ ঘোষণার শেষ দিন। এজন্য ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন ও চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ’২৫) এর প্রতিবেদন চূড়ান্ত ও অনুমোদন করতে ইসলামী ব্যাংক প্রথমে পর্ষদ সভা ডেকেছিল গত ২৮ এপ্রিল।
আরও পড়ুন<<>>ইসলামী ব্যাংকের এমডি হওয়ার দৌড়ে দুর্নীতির সহায়ক ওমর ফারুক
সেদিনও কোনো এনওসি না পেয়ে আশা করেছিল সবশেষ শেষ দিন গত ৩০ এপ্রিল পেতে পারে। এ ভরসায় ফের ৩০ এপ্রিল পর্ষদ সভা ডাকে ব্যাংকটি। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনো সাড়া না পেয়ে পর্ষদ সভা শেষ করে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। এতে ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান বলেন, আমরা আশা করছি পেয়ে যাবো। এনওসি না পাওয়ায় হিসাব চূড়ান্ত করতে পারছি না। অ্যাকাউন্স যদি ফাইনাল করতে না পারি তাহলে কিছুই বলতে পারবো না। মুনাফাই হবে, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনওসি দিলে ঘোষণা করতে পারবো। বিএসইসি ও ডিএসইকে জানিয়েছে বলেছেন তিনি।
গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা
আশা ছিল, শেষ মূহুর্তে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন দিবে। কিন্তু সরকারি অফিস সময় শেষ হয়ে রাত গড়ালেও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ২০২৪ সালের আর্থিক বিবরনী চূড়ান্ত ও পর্ষদে অনুমোদন না করেই গভীর রাতে সভা শেষ করে ব্যাংক।
লোকসানের পথেই হাঁটছে
ব্যাংকটি সবশেষ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক অবস্থা জানিয়েছে গত সেপ্টম্বর পর্যন্ত। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটি ৮৯ কোটি ২০ লাখ টাকার নিট লোকসান করে। অথচ গতবছর একই সময়ে ব্যাংকটি কর পরবর্তী নিট মুনাফা করেছিল ৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন>>>ইসলামী ব্যাংকে জালিয়াতের অভিযোগে এমডির বাধ্যতামূলক ছুটি
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির প্রথম আর্থিক প্রতিবেদন ছিল সেটি। এ সময়ে আর্থিক খাতের অন্যান্য খাতের মতো ব্যাংক খাতেও নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। নতুন নেতৃত্ব এসেই ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। বদলানো হয় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। নতুন চেয়ারম্যান করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ মাসুদকে। তাদের নেতৃত্বের সময়ে প্রথম প্রকাশিত প্রতিবেদনে লোকসান বের হয়ে আসে ব্যাংকটির।
আগের দুই প্রান্তিকে মুনাফায় থাকলেও তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান দেখতে পায়। এ প্রান্তিকে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৫৫ পয়সা। আর আগের বছর একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি লাভ হয়েছিল ৫৯ পয়সা।
এতে গত ২০২৪ সালের নয় মাস শেষে ব্যাংকের নিট মুনাফাও কমে যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ(ডিএসই) এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গত ২০২৪ সালের ৯ মাসের হিসাবে অর্থাৎ জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে। নয় মাসে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ২৬৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। যেখানে ২০২৩ সালের একই সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা হয়েছিল ৪৩৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমে ১৭০ কোটি ৯ লাখ টাকা বা ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
জরিমানার কবলে পড়তে পারে
শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে আগের হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে নতুন বছরের প্রথম দুই মাসের মধ্যে। এ সময়ে নিরীক্ষা শেষে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে আবেদন করে আরো দুই মাস সময় বাড়ানো যাবে।
বছরের প্রথম চার মাসের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হবে। সেটি না করলে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসি) এর নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো জরিমানার কবলে পড়তে পারে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্পর্কিত কোনো কারণে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারলে বিএসইসিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে অবহিত করতে হবে। এরকম পরিস্থিতি হলে, কতো সময়ের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়নি বিএসইসি। এ নীতির আলোকে তালিকাভূক্ত ব্যাংকগুলো বিএসইসিকে গত বুধবার রাতেই জরুরি ফ্যাক্স ও সরাসরি চিঠি জমা দিয়েছে।
আরও পড়ুন<<>> এবার জলিলে ডুবছে ইসলামী ব্যাংক!
শেয়ার বাজারের নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিষয়ে পর্ষদ সভা ডাকার পরে তা বিনিয়োগকারীদের জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে। বিনিয়োগকারিদের জানাতে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ সভার তরিখ ও সভার সুচি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর নীতিমালা অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত ও ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা পিএসআই হিসেবে বিএসইসি ও দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পরের দিন দুটি জাতীয় পত্রিকায় তা প্রকাশ করার পাশাপাশি একটি অনলাইন নিউজপোরটালে দ্রুত প্রকাশ করতে হবে পিএসআই।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও পিএসআই ও চুড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। পরের দিন স্টক এক্সচেঞ্জ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে ও করপোরেট ঘোষণা থাকায় সেদিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দরে কোনো সার্কিট ব্রেকার থাকবে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত না হওয়ায় কোনো পিএসআই প্রকাশ করেনি ব্যাংকটি।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।