Apan Desh | আপন দেশ

‘শাকসবজি-ফল উৎপাদনে গবেষণার নবদিগন্ত’

ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ১৯ মে ২০২৫

আপডেট: ২১:৩৭, ১৯ মে ২০২৫

‘শাকসবজি-ফল উৎপাদনে গবেষণার নবদিগন্ত’

ছবি: আপন দেশ

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি উন্নয়ন এবং কৃষির টেকসইতা অর্জনের জন্য উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।

শাকসবজি ও ফলমূল শুধু মানুষের খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্য আনে না, বরং দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে, যা সুস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সকল উপাদান শিশু ও নারীদের পুষ্টি উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত সহায়ক। তাই বাংলাদেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জনগণের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে উদ্যানতত্ত্বভিত্তিক গবেষণা, সম্প্রসারণ ও আধুনিক প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম এবং ক্রমবর্ধমান।

বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশে ধান, গম, ভুট্টা ও আলুর মতো প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিকে যতটা মনোযোগ দেয়া হয়েছে, শাকসবজি ও ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে এখনও তা দেয়া হয়নি। যদিও এ খাতে ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, তবে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব ও বিনিয়োগ এখনও অপর্যাপ্ত। তবে বিগত দুই দশকে সরকারি ও বেসরকারি খাতে গবেষণা, সম্প্রসারণ কার্যক্রম এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক চাহিদার ফলে উদ্যানতাত্ত্বিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা কৃষকদের আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির শাকসবজি ও ৭০ প্রজাতির ফল চাষ হয়, যা পুষ্টি নিরাপত্তা এবং রফতানি সম্ভাবনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গবেষণার অগ্রগতি: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (IPHN), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, এবং বিভিন্ন এনজিও এ খাতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। BARI এখন পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল এবং পুষ্টিকর সবজি ও ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

সবজির জাত
বারি টমেটো-১৬, বারি টমেটো-১৭, বারি টমেটো-১৮, বারি টমেটো-১৯, বারি টমেটো-২০, বারি টমেটো-২১, বারি হাইব্রিড টমেটো-১০ (গ্রীষ্মকালীন), বারি হাইব্রিড টমেটো-১১; বারি বেগুন-১১, বারি বেগুন-১২,  বারি হাইব্রিড বেগুন-৫;  বারি করলা-১, বারি করলা-২,  বারি করলা-৩,  বারি করলা-৪, বারি হাইব্রিড করলা-৩; বারি লাউ-৩, বারি লাউ-৪, বারি লাউ-৫; বারি শিম-১, বারি শিম-৭(গ্রীষ্মকালীন),  বারি শিম-৮, বারি শিম-৯, বারি শিম-১০; বারি মূলা-৪; বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-১, বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া-২, বারি হাইব্রিড মিষ্টি কুমীনগ; বারি বেগুন-১১, বারি বেগুন-১২, বারি হাইব্রিড বেগুন-৫; বারি ঝিঙ্গা-২; বারি চিচিঙ্গা -১; বারি বরবটি -১;  বারি বরবটি-২; বারি লেটূশ-১; বারি ঢেঁড়স-১, বারি ঢেঁড়স-২; বারি ধুন্দল-১, বারি ধুন্দল-২, বারি হাইব্রিড ধুন্দল-১, যেগুলো অধিক ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং ভিটামিনসমৃদ্ধ।

ফলের জাত
বারি  কাঁঠাল-৩, বারি  কাঁঠাল-৪, বারি  কাঁঠাল-৫, বারি কাঁঠাল-৬; বারি আম-৩, বারি পেঁপে-২, বারি আম-৪ (হাইব্রিড), বারি আম-৫, বারি আম-৬, বারি আম-৭ বারি আম-৮, বারি আম-৯, বারি আম-১০, বারি আম-১১, বারি আম-১২, বারি আম-১৩ (হাইব্রিড), আম-১৭ (হাইব্রিড), বারি আম-১৮ (হাইব্রিড); বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩, বারি লিচু-৪, বারি লিচু-৫; বারি কলা-১, বারি কলা-২, বারি কলা-৪, বারি কলা-৫; বারি পেয়ারা-৪ (বীজ বিহীন); বারি মাল্টা-১, বারি মাল্টা-২, বারি কমলা-১, বারি কমলা-২, বারি কমলা-৩; বারি বাতাবিলেবু-৩, বারি বাতাবিলেবু-৫, বারি বাতাবিলেবু-৬; বারি আমড়া-১; বারি সফেদা-১, বারি সফেদা-২, বারি সফেদা-৩; বারি কুল-১ (নারিকেলি কু্ল),বারি কুল-২ (খাসার কুল), বারি কুল-৩, বারি কুল-৪, বারি কুল-৫, বারি ড্রাগন ফল-১; বারি লটকন-১, বারি লটকন-২; বারি অ্যাভোকাডো-১ এবং বারি তরমুজ-১, বারি তরমুজ-২, যেগুলো রসালো, উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর।

পুষ্টির দৃষ্টিকোণ
বাংলাদেশে অপুষ্টি এখনও একটি প্রধান ও দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। জাতীয় পুষ্টি জরিপ (BNNS) ২০১৮ অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৮% খর্বাকৃতি (stunted), ৯.৮%  কৃশ (wasted) এবং ২২.৬% কম ওজনযুক্ত (underweight)। অন্যদিকে, গর্ভবতী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪১% রক্তশূন্যতায় ভুগছেন এবং ভিটামিন-এ, আয়রন ও দস্তার ঘাটতি এখনও ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এ অবস্থা দেশের ভবিষ্যৎ জনসম্পদ ও উৎপাদনশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।

আরও পড়ুন <<>>  কালীগঞ্জে জনপ্রিয় হচ্ছে বস্তায় আদা চাষ

শাকসবজি ও ফলমূলের দৈনন্দিন গ্রহণ বাড়িয়ে, পাশাপাশি পুষ্টিসমৃদ্ধ উন্নত জাতসমূহ সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করে তুললে এ সমস্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অন্তত ৪০০ গ্রাম ফল ও শাকসবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশে গড় গ্রহণ মাত্র ১৬০-২০০ গ্রাম, যা সুপারিশকৃত মাত্রার অর্ধেকেরও কম।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেমন বারি পেঁপে-২ জাতে বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ২,৮০০ মাইক্রোগ্রাম, যা ভিটামিন-এ এর ঘাটতি পূরণে সহায়ক এবং রাতকানা ও চোখের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। একইভাবে, বারি ডাটাশাক-১ এ প্রতি ১০০ গ্রামে আয়রনের পরিমাণ প্রায় ৬.৫ মিলিগ্রাম, যা নারীদের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, পুষ্টিকর জাতের উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন<<>> ভূগর্ভের পানি শেষের পথে!

টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি: গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ শাকসবজি ও ফলের আধুনিক চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে:

* অফ-সিজন উৎপাদন: শীতকালীন শাকসবজি- যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো এখন গ্রীষ্মকালেও চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
* রেইনশেল্টার ও হাইটানেল প্রযুক্তি: বর্ষাকালে এবং ঝড়ের সময়ও ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
* জৈব চাষ ও আইপিএম (সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা): রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জসমূহ 
উদ্যানতাত্ত্বিক গবেষণা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে: ১) জেনেটিক বৈচিত্র্যের সীমাবদ্ধতা: অনেক দেশীয় প্রজাতি বিলুপ্তির পথে; ২) রোগবালাই ও জলবায়ু পরিবর্তন: নতুন রোগ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে; ৩) সার ও বীজের অপ্রতুলতা: মানসম্মত বীজের অভাব রয়েছে; ৪) সীমিত সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা: দ্রুত পচনশীল এ পণ্যগুলো সংরক্ষণ ও পরিবহনে সমস্যা রয়েছে এবং ৫) গবেষণায় বাজেট ও দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি। 

ভবিষ্যৎ করণীয় 

১) উন্নত জাত উদ্ভাবন: জলবায়ু সহনশীল, অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে; ২) ন্যানো ও জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ: উৎপাদনশীলতা ও পুষ্টিমান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে; ৩) কৃষকদের প্রশিক্ষণ: কৃষকদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে; ৪)  বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ: প্রাইভেট কোম্পানি ও এনজিওদের গবেষণা ও বীজ উৎপাদনে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতে হবে;৫) উদ্যানতাত্ত্বিক গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন: উদ্যানতত্ত্বের জন্য পৃথক ও বিশেষায়িত গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে এবং ৬)  রফতানিযোগ্য পণ্য উন্নয়ন: ফলমূল ও শাকসবজিকে প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে উদ্যানতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে পুষ্টিকর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাতের উন্নয়নে যথাযথ নীতি, বিনিয়োগ, গবেষণা এবং সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি কৃষকের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিতে এবং টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য উদ্যানতত্ত্বভিত্তিক গবেষণাকে আরও জোরদার করতে হবে।


লেখকঃ কৃষি বিজ্ঞানী ও প্রাক্তন মহাপরিচালক, বিএআরআই
ইমেইল: [email protected]

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়