
ছবি: আপন দেশ
প্রকৃতির আঁচলে বসন্তের রঙ বিদায় নিয়েছে বহুদিন আগেই। এখন চারদিকে রোদের তীব্র খেলা, গরম বাতাসের দহন, নিঃস্তব্ধ ও ক্লান্ত প্রকৃতি যেন নিঃশব্দ চিৎকারে জানান দিচ্ছে—গ্রীষ্ম এসে গেছে। পথের ধুলোমাখা ক্লান্ত পথিক, ঘামে ভেজা শরীর আর একফোঁটা জলের তৃষ্ণায় ছটফট করা মুহূর্তগুলো মিলে গ্রীষ্ম যেন বাস্তবের আয়নায় ধরা দিয়েছে।
তবে খরতাপে পোড়া এ গ্রীষ্মকালেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) যেন প্রকৃতির এক রঙিন উৎসব। রাজশাহীতে গরমের তীব্রতা প্রখর হলেও রাবি ক্যাম্পাসে যেন বিরাজ করছে ঋতুরাজ বসন্ত। জ্যৈষ্ঠের এ খরতাপেও ক্যাম্পাসের প্রকৃতি নিজেকে দিয়েছে উজার করে। সূর্যের দাবদাহকে অগ্রাহ্য করে প্রকৃতি এখানে আঁকছে রঙ, সুবাস আর স্বপ্নের এক অপরূপ ক্যানভাস। গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুরগুলোকেও যেন মধুময় করে তুলছে এই রঙের বন্যা। কাঠফাটা রোদেও নয়নাভিরাম প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন প্রকৃতি প্রেমীরা।
এপ্রিল মাসজুড়ে রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তীব্র তাপদাহ। তাপদাহে মানুষের মতো বৃক্ষরাজিও যেন ছিল হাঁসফাঁস অবস্থায়। তবে ধুঁকতে থাকা সে বৃক্ষরাজি কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ফিরে পেয়েছে প্রাণ। হারানো যৌবন পেয়ে নিজেকে ভরে তুলেছে ফুলে-ফলে। রঙিন এসব ফুলে বর্ণিল মতিহারের এ সবুজ চত্বর। প্রচণ্ড খরতাপেও প্রকৃতিকে বসন্তের রঙে সাজিয়েছে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু, কাঠগোলাপ, রক্ত জবা, বকুলসহ নাম না জানা বাহারি জাতের ফুল।
কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িগুলো খসতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। গাছের শাখায়ও গজিয়েছে নতুন পাতা। লাল জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয় এক অনির্বচনীয় উত্তাপ। গ্রীষ্মের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা জীবনের রক্তিম গান।
আরও পড়ুন>>>আ.লীগ নিষিদ্ধে রাবিতে বিজয় মিছিল
ক্যাম্পাসের সত্যেন্দ্রনাথ বসু অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। স্টেশন বাজার ও সিনেট ভবনের সামনে থাকা কৃষ্ণচূড়ার লাল পাপড়ির নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয়, ক্লান্ত জীবনও যেন নবচেতনায় ভরে ওঠে।
তপ্ত বাতাসের ফাঁকে জারুলের বেগুনি ফুলেরা গায় রূপকথার ঘুমপাড়ানি গান। বেগুনি ঝরনায় ভেসে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ, পশ্চিমপাড়ার মেয়েদের হল, পূর্বপাড়া থেকে বদ্ধভূমির রাস্তা ও চারুকলাসহ আশপাশ। গ্রীষ্মের তীব্র রোদও যেন হার মেনে নেয় জারুলের মৃদু ছায়ার কাছে।
সোনালুর ঝরনার মতো মালায় গ্রীষ্মের ঘাম ঝরে গিয়ে জন্ম নেয় প্রকৃতির নতুন গান। ঝরনার মতো ঝুলে থাকা সোনালুর সোনালি ফুলে ঢেকে গেছে ক্যাম্পাসের অনেক স্থান। রোদের উত্তাপে হাঁপানো মনকেও ঠান্ডা করে দেয় সোনালি পরশ।
চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যপট—রক্তিম, বেগুনি আর সোনালির ক্যানভাসে ফুটে ওঠে জীবনের রঙিন গল্প। প্রতিদিন নতুন রঙের আবেশে যেন ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণ একেকটি জীবন্ত দৃশ্যপট হয়ে ওঠে। এ রঙের খেলায় মন খুঁজে পায় এক পরম প্রশান্তি, প্রকৃতির এ মুগ্ধতায় ভরে ওঠে অন্তর। যেন বোঝাপড়া হয়ে যায় নিস্তব্ধতায়, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার প্রেমে মাতোয়ারা।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া তানজীম বলেন, গ্রীষ্মের রোদে পোড়া এ দিনগুলোতে কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমি আগুনের ভেতরেও শান্তি খুঁজে পাই। এ লালের মধ্যে একটা বুনো মুক্তি খুঁজে পাই।
আরও পড়ুন>>>নারী শিক্ষার্থীকে কাকের সঙ্গে তুলনা, রাবি ছাত্রদলের নিন্দা
ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম বলেন, জারুলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, সময় থেমে গেছে, আমি এক অনন্ত বিকেলের ভেতর হারিয়ে গেছি। এ ফুলগুলো যেন এক স্বপ্নের মতো, জীবনের সব চাপকে দূর করে দেয়।
নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী ঐশ্বরিয়া রায় বলেন, আমি যখন সোনালুর ঝুলন্ত ফুলের নিচে দাঁড়াই, মনে হয় কোনো পুরনো সিনেমার দৃশ্যে চলে এসেছি। এ ক্যাম্পাস আমাকে প্রতিদিনই এক নতুন গল্পের ভেতর ফেলে দেয়। গ্রীষ্ম এখানে শুধু ঋতু নয়, এটা একটা প্রাণবন্ত দৃশ্যপট।
প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনন ও সৃষ্টিশীলতাকে জাগিয়ে তোলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণচূড়া, জারুল আর সোনালুর এ গ্রীষ্মকালীন সৌন্দর্য কেবল চোখের আরাম নয়, এটি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনবোধের এক নিটোল অনুপ্রেরণা। যখনই দেখি এ ফুলেরা ক্যাম্পাস জুড়ে ফুটে আছে, মনে হয়— জীবনের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে যায়, নতুন কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা জাগে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করে দেয়, প্রকৃতি কখনও ক্লান্ত হয় না। ফুল ফোটে, ঝরে, আবার ফুটে। এ চক্রের ভেতর দিয়েই জীবন চলে। গ্রীষ্মের রৌদ্রদাহের মধ্যেও এখানে প্রতিটি পাপড়িতে লেখা থাকে আশা, সৌন্দর্য আর নতুন সৃষ্টির আহ্বান। ছায়াপথের নিচে দাঁড়িয়ে ঝরা ফুলের ঘ্রাণে ভেসে যায় স্মৃতি, হঠাৎ মনে হয়, জীবন তো আসলে গ্রীষ্মের মাঝে এক চিরন্তন ফুলবৃষ্টি।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।