
ফাইল ছবি
খেজুর পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও পুষ্টিকর ফল। এটি শুধু একটি সাধারণ খাদ্য নয়, বরং শক্তি, স্বাস্থ্য ও বরকতের এক জীবন্ত প্রতীক। হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাসে খেজুর তার অনন্য স্থান দখল করে আছে। মরুভূমির বালুকায় খেজুরগাছ টিকে থাকে অল্প পানিতে, তীব্র রোদে, কঠিন পরিবেশে; তবুও এটি ফল দেয়, জীবন দেয়, ছায়া দেয়। ঠিক তেমনি মানবজীবনের প্রতীক হয়ে খেজুর আজও ধৈর্য, সহনশীলতা ও আশার বার্তা দেয়।
খেজুরের বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera। এটি পাম গাছ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় চাষ হয়। পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলে খেজুরগাছের উপস্থিতি যেন জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে থেকেই খেজুর মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, পারস্য ও মিশরীয় সভ্যতায় এটি ছিল পবিত্র ফল। ফেরাউনের কবরেও খেজুর রাখা হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করত— মৃত্যুর পরের জীবনে এটি আত্মাকে শক্তি দেবে।
ইসলামের ইতিহাসে খেজুরের স্থান অনন্য। কুরআনে একাধিক স্থানে খেজুরের উল্লেখ রয়েছে। সূরা মারইয়ামে বলা হয়েছে, নবী ঈসা (আ.)-এর মা মরিয়ম যখন সন্তান জন্মদানের সময় তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে খেজুরগাছ নাড়াতে বলেন, যাতে গাছ থেকে পাকা খেজুর পড়ে। মরিয়ম সেই খেজুর খেয়ে শক্তি পান এবং নবজাতক সন্তানের জন্ম দেন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে খেজুরে আছে প্রাকৃতিক শক্তি, যা শারীরিক দুর্বলতা দূর করে এবং প্রসবের সময় সহনশক্তি বাড়ায়।
আরও পড়ুন>>>কুড়িগ্রামে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর পাশে ব্র্যাক
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনেও খেজুরের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি প্রায় প্রতিদিন খেজুর খেতেন এবং তাঁর সাহাবিদেরও খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা রোজা ভাঙো খেজুর দিয়ে, যদি তা না পাও তবে পানি দিয়ে।” (তিরমিজি)। এই হাদীস আমাদের জানায়, খেজুর হলো প্রাকৃতিক শক্তির উৎস এবং রোজার দীর্ঘ সময় পর শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে এর জুড়ি নেই। আরেক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তার ওপর কোনো বিষ বা জাদুর প্রভাব পড়বে না।” (বুখারি)। এ থেকেই বোঝা যায় খেজুর কেবল পুষ্টিকর নয়, বরং আত্মিক ও শারীরিক নিরাপত্তার প্রতীকও বটে।
খেজুরের পুষ্টিগুণ সত্যিই বিস্ময়কর। এতে আছে প্রাকৃতিক চিনি— গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ ও সুক্রোজ, যা দেহে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে প্রায় ২৭৭ ক্যালোরি শক্তি, ৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৭ গ্রাম ফাইবার, ২ গ্রাম প্রোটিন, ৬৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৫৪ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ১ মিলিগ্রাম আয়রন এবং ৬৯৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে। এছাড়া এতে রয়েছে ভিটামিন–বি৬, ভিটামিন–কে, ফলেট ও প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— খেজুরে কোনো কোলেস্টেরল বা ট্রান্স ফ্যাট নেই। এই কারণে এটি হৃদরোগী ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সীমিত পরিমাণে নিরাপদ ও উপকারী।
খেজুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যেমন ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড ও ফেনোলিক অ্যাসিড কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। এগুলো শরীরের ভিতরে তৈরি হওয়া ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক ক্ষতিকর অণু দূর করে, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ ও বার্ধক্য ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হৃদপিণ্ডকে সক্রিয় রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, আর আয়রন ও ফলেট রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে।
খেজুরের আরেকটি বিশেষ গুণ হলো এটি দ্রুত শক্তি জোগায়। দীর্ঘ সময় উপবাস থাকার পর খেজুর শরীরে গ্লুকোজ সরবরাহ করে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে তোলে। তাই মুসলমানরা ইফতারে প্রথমেই খেজুর খান—এটি শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং একটি বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যনীতি।
নিয়মিত খেজুর খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। পটাশিয়াম হৃদযন্ত্রের ছন্দ ঠিক রাখে এবং রক্তনালিকে মজবুত করে। ফ্ল্যাভোনয়েড কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তে জমে থাকা চর্বি হ্রাস করে। এতে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
খেজুর রক্তশূন্যতা দূর করতেও কার্যকর। এতে থাকা আয়রন ও ফলেট রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য খেজুর অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন তিন থেকে চারটি খেজুর খেলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, ত্বক উজ্জ্বল হয় এবং মনোযোগ বাড়ে।
হজমে খেজুরের ভূমিকা অপরিসীম। এতে প্রচুর ফাইবার আছে, যা অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত খেজুর খেলে অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে, যা হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। এছাড়া এটি গ্যাস্ট্রিক, অম্লতা ও হজমের গণ্ডগোলও প্রতিরোধ করে।
খেজুরে উপস্থিত ফেনোলিক যৌগ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে। এই উপাদানগুলো ক্যান্সার কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধ করে এবং নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়াকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে।
খেজুরে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম থাকার কারণে এটি হাড় ও দাঁতের জন্যও খুব উপকারী। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায় এবং অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধ করে। শিশুদের হাড়ের গঠন শক্ত করতে নিয়মিত খেজুর খাওয়ানো ভালো।
গর্ভবতী মা ও নবজাতকের জন্য খেজুর একটি প্রাকৃতিক ওষুধ। সূরা মারইয়ামের ঘটনা অনুযায়ী যেমন আল্লাহ খেজুরকে প্রসবকালীন খাদ্য হিসেবে নির্দেশ দিয়েছেন, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও তেমনই বলছে—খেজুর গর্ভাবস্থায় জরায়ুর পেশি শক্ত করে, প্রসব সহজ করে এবং প্রসবের পর রক্তক্ষয় কমায়। এতে থাকা ফোলেট শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে।
শিশুদের জন্য খেজুর হলো প্রাকৃতিক মাল্টিভিটামিন। খেজুরের রস দুধ বা পায়েসের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এটি শিশুদের শক্তি, বুদ্ধি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
মানসিক স্বাস্থ্যে খেজুরের প্রভাবও প্রশংসনীয়। এতে থাকা পলিফেনল মস্তিষ্কের কোষে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে, মানসিক চাপ কমায় এবং ঘুমে সহায়তা করে। খেজুরে থাকা ম্যাগনেসিয়াম ও ট্রিপটোফ্যান শরীরে সেরোটোনিন উৎপন্ন করে, যা মনোভাব উন্নত করে এবং বিষণ্নতা প্রতিরোধ করে।
যৌন স্বাস্থ্যেও খেজুর কার্যকর। এটি প্রাকৃতিক অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে কাজ করে। খেজুর দুধে ভিজিয়ে খেলে পুরুষদের শক্তি, সহনশক্তি ও শুক্রাণুর গুণগত মান বাড়ে। নারীদের ক্ষেত্রেও এটি হরমোন ভারসাম্য রক্ষা করে এবং প্রজননক্ষমতা উন্নত করে।
বিশ্বে খেজুরের প্রায় তিন শতাধিক প্রজাতি আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো মদিনার আজওয়া খেজুর। হাদীসে বর্ণিত আছে, আজওয়া খেজুর জাদু ও বিষ থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও মাবরুম, সুক্কারী, সাফাওয়ি, মেজুল, ডেগলেট নুর ইত্যাদি জাতের খেজুরও জনপ্রিয়। আজওয়া খেজুরের রঙ কালচে, স্বাদ মোলায়েম, আর এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ অন্যান্য খেজুরের তুলনায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশেও খেজুর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দক্ষিণাঞ্চলের যশোর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা ও বরিশাল অঞ্চলে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরি করা হয়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে খেজুরের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসায় খেজুরকে ‘প্রাণদায়ী ফল’ বলা হয়। দুর্বলতা, ক্লান্তি, জ্বরের পর অবসাদ দূর করতে এটি কার্যকর। ইউনানি চিকিৎসায় বলা হয়, খেজুর শরীরে রক্ত বাড়ায়, বল বৃদ্ধি করে, যৌন দুর্বলতা দূর করে এবং মন শান্ত রাখে। আধুনিক গবেষণাও বলছে, খেজুর দেহে গ্লাইকোজেন সঞ্চয় বাড়ায়, ফলে শরীর দীর্ঘ সময় সক্রিয় থাকে।
বিশ্বব্যাপী খেজুর একটি বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সৌদি আরব, ইরান, মিশর, আলজেরিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ৪০টিরও বেশি দেশে খেজুরের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় নয় মিলিয়ন টন খেজুর উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য বিলিয়ন ডলারে গোনা হয়। খেজুর থেকে তৈরি হচ্ছে সিরাপ, পেস্ট, স্বাস্থ্য পানীয়, মিষ্টান্ন, এমনকি কসমেটিক সামগ্রীও।
খেজুর সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হয়। অতিরিক্ত আর্দ্র পরিবেশে রাখলে এতে ছত্রাক জন্মায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই খেজুর সবসময় শুকনো, ঠান্ডা স্থানে রাখা উচিত। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দিনে দুই থেকে তিনটির বেশি খাওয়া ঠিক নয়, কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনি থাকলেও অতিরিক্ত পরিমাণে তা রক্তে গ্লুকোজ বাড়াতে পারে।
খেজুর শুধু খাদ্য নয়, এটি মানবজীবনের নৈতিক প্রতীক। মরুভূমিতে যেমন খেজুরগাছ সামান্য পানিতে বেঁচে থাকে, তেমনি মানুষকেও সীমিত উপকরণে বড় কিছু অর্জন করার শিক্ষা দেয়। আরব কবিরা বলেন—যেমন খেজুরগাছ শুকনো বালিতে শিকড় ছড়িয়ে আকাশ ছোঁয়, তেমনি মানুষও কষ্ট সহ্য করে উন্নতির শিখরে পৌঁছায়।
খেজুর আমাদের শেখায় সহনশীলতা, দানশীলতা ও ধৈর্যের পাঠ। এটি শুধু শরীর নয়, মনকেও পুষ্ট করে। নবীর প্রিয় ফল হিসেবে খেজুর আমাদের জন্য বরকতের প্রতীক, জীবনের শক্তি ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।
খেজুর হলো এমন এক ফল যা প্রকৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান ও মানবজীবনের প্রতিটি দিকেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কয়েকটি খেজুর রাখলে শরীর পায় পুষ্টি, মন পায় প্রশান্তি, আর আত্মা পায় বরকত। সত্যিই, খেজুর কেবল একটি ফল নয়—এটি জীবনের মিষ্টতা ও সুস্থতার প্রতীক।
আপন দেশ/এমবি