
প্রতীকী ছবি
আমাদের সমাজে মাঝেমধ্যে এমন খবর শোনা যায় যে, ‘সে এক রাতেই ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেছে!’ শুনলেই চমকে উঠি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কি আদৌ সত্য? আসলে এটি একটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণা।
মানুষ কোনো এক রাতে হঠাৎ করে তার লিঙ্গ পরিচয় বদলায় না। এ পরিবর্তন কোনো ম্যাজিক নয়—বরং আত্ম-অনুসন্ধান, আত্মচেতনার, কখনোবা মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের দীর্ঘ যাত্রার ফসল।
শৈশব থেকে কৈশোর অতঃপর বয়সন্ধিকাল—এ দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় একজন মানব শিশু হরমোন, জেনেটিক্স, পরিবার, সমাজের সহায়তায় সে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে—সে আসলে কে, কী চায়, নিজেকে কীভাবে দেখে, তাকে কীভাবে উপস্থাপন করা উচিত। এটি কখনোই হুট করে ঘটার বিষয় নয়। (APA, 2021; Zucker, 2017)
কেউ ছোটবেলায় অল্প সময়ে নিজের পরিচয় বুঝতে পারে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা ঘটতে পারে একটু দেরীতে তরুণ বা প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে। নাম পরিবর্তন, পোশাক, আচার-আচরণ, কিংবা সর্বনাম (he/she/they) বেছে নেয়ার পেছনে থাকে মানসিক প্রস্তুতি, হরমোনজনিত প্রভাব, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। সব মিলিয়ে এ এক জটিল ও মানবিক প্রক্রিয়া। (Olson & Gülgöz, 2018)
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, লিঙ্গ পরিচয় কারও খেয়ালখুশিমতো গঠিত নয়। এটি জৈবিক, মানসিক ও পরিবেশগত কারণে ধীরে ধীরে তৈরি হয়। (APA, 2021; WPATH, 2022)
তাই জেন্ডার ডিসফোরিয়া, LGBTQ+পরিচয়, মানসিক চাপ—এসব বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে সঠিক বোঝাপড়া গড়ে তোলা আজ জরুরি। (WPATH, 2022)
আমরা যদি বিষয়গুলোকে বিজ্ঞানের চোখে দেখি, তবে আমাদের সমাজে এসব নিয়ে বিভ্রান্তি, রেষারেষি ও বৈষম্য অনেকটা কমবে। পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদা বাড়বে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
আরও পড়ুন<<>>ক্যান্সারে ক্ষতিগ্রস্ত চোয়াল প্রতিস্থাপন
লিঙ্গ নির্ধারণে মস্তিষ্কের উপর হরমোনের প্রভাব
নিউরো গবেষণা বলছে, লিঙ্গ পরিচয়ের গঠন অনেকাংশে নির্ভর করে ব্রেইনের উপর হরমোনের প্রভাবে, যার সূচনা হয় মাতৃগর্ভেই। গর্ভকালীন সময়ে অ্যান্ড্রোজেন ও এস্ট্রোজেন হরমোন মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তীকালে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় ও আচরণে ভূমিকা রাখে। (Bao & Swaab, 2011)
শুধু তাই নয়, যেসব ক্ষেত্রে জৈবিক লিঙ্গ (biological sex) ও লিঙ্গ পরিচয়ের (gender identity) মধ্যে জটিলতা দেখা যায়, সেখানে মস্তিষ্কের গঠন ও হরমোন-সংবেদনশীল অংশগুলোর কার্যকারিতায় স্পষ্ট পার্থক্য পাওয়া গেছে। (Garcia-Falgueras & Swaab, 2008)
ইসলামের দৃষ্টিতে লিঙ্গ বৈচিত্র্য
ইসলামে আল্লাহর সৃষ্টি ও ফিতরাতকে সম্মান করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। (Sura Ar-Room Ayat 30)
নবী করিম (স.) এর যুগে লিঙ্গ বৈচিত্র্যসম্পন্ন মানুষ সমাজে উপস্থিত ছিল যাদের বলা হতো মুখাননাস এবং তাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণকে কখনও উৎসাহ দেয়া হয়নি ( Muslim- 4067)।
শুধু তাই নয়, ইসলাম সর্বদা মানবিকতা ও ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দেয়। (Sura An Nisa, 4;58)
তাই অতিরঞ্জিত খবর, ভুল ব্যাখ্যা বা ঘৃণামূলক আচরণের পরিবর্তে আমাদের উচিত জ্ঞানের ভিত্তিতে LGBTQ+বোঝা এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদানে উৎসাহ প্রদান করা।
লেখক: চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট, জনস্বাস্থ্য গবেষক।
আপন দেশ/জেডআই