
ফাইল ছবি
সাউথইস্ট ব্যাংক অভ্যন্তরীণ তদন্তের ভিত্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে। চুক্তিবহির্ভূত এক বিনিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি অ্যান্টি মানিলন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার খোরশেদ আলম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ‘ইএম পাওয়ার লিমিটেড’ নামে একটি অখ্যাত ও তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (Pre-IPO) শেয়ার ক্রয়ের একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই সম্পাদিত হয়। যা তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের মৌখিক নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. কামাল হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হয়। এতে ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানাও যুক্ত ছিলেন।
চুক্তির আওতায় প্রতি শেয়ারে ১৫ টাকা করে মোট দেড় লাখ শেয়ার কেনা হয়। যার মধ্যে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য ও ৫ টাকা প্রিমিয়াম ছিল। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ইএম পাওয়ার লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়া হয়। কিন্তু সাত দিনের মধ্যে এই অর্থ ৯টি পৃথক চেকের মাধ্যমে অজ্ঞাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। যার কোনো তথ্য ব্যাংকের রেকর্ডে নেই।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ব্যাংককে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ দেয়া হয়নি। এমনকি তালিকাভুক্তির কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১৩টি চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে মূল বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত এলেও নির্ধারিত ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা লভ্যাংশ ফেরত আসেনি।
আরও পড়ুন>>>শেয়ারবাজারের জন্য প্রধান উপদেষ্টার ৫ নির্দেশনা
২০২৫ সালের ১০ মার্চ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে বলা হয়—এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছিল না, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পূর্বানুমতি ছাড়াই Pre-IPO শেয়ার কেনা হয়েছে। কোম্পানির CIB রিপোর্ট, অডিটেড আর্থিক প্রতিবেদন বা প্রসপেক্টাস যাচাই করা হয়নি। এমনকি চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে স্বাক্ষরকারী মো. আনসার উদ্দিনের পরিচয় যাচাইও করা হয়নি।
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ রয়েছে, ইএম পাওয়ার লিমিটেড বিএসইসির কাছে আইপিও অনুমোদনের জন্য কোনো আবেদন করেনি। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ব্যক্তিস্বার্থে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মতে, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা ও আত্মসাতের ঘটনা, যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার করেছেন।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা হলেন- ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক আলমগীর কবির, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. কামাল হোসেন, ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট জেসমিন সুলতানা, ইএম পাওয়ার লিমিটেডের প্রতিনিধি মো. আনসার উদ্দিন ও সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন ব্যক্তি।
এছাড়া, সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের রাজনৈতিক প্রভাবকেও এ দুর্নীতির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এ সাবেক চেয়ারম্যান বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন মহলের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি নানামুখী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। যা সুশাসনের পরিবর্তে অনিয়মকেই উৎসাহিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আমরা গ্রাহকের অর্থ ও আস্থা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমরা নিজেরাই যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করবে।
অর্থখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকটির এ পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত। একইসঙ্গে অন্যান্য ব্যাংকের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হওয়া যাবে না। জানা গেছে, ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম ঠেকাতে সাউথইস্ট ব্যাংক নতুন বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের কাজও শুরু করেছে।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।