
সংগৃহীত ছবি
যদি আপনি সবুজের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চান, ইতিহাসের অলিগলি ছুঁয়ে দেখতে চান শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য, কিংবা পাহাড়ি প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বান শুনতে চান- তবে আপনাকে যেতে হবে শেরপুরে। মেঘালয়ের কোলঘেঁষা এ সীমান্তবর্তী জেলা যেন একাধারে জীবন্ত ইতিহাস, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির এক চমৎকার মিলনমেলা।
গারো পাহাড়ের পাদদেশে ছড়িয়ে থাকা ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিস্তৃত বনভূমি, শাল-সেগুনের বনরাজি আর খরস্রোতা নদী যেন চোখ জুড়ানো এক স্বপ্নপুরী। পাহাড়ি টিলায় গড়ে ওঠা মধুটিলা ইকোপার্ক, গজনী অবকাশ কেন্দ্র কিংবা রাজার পাহাড় আপনাকে উপহার দেবে অনন্য এক প্রকৃতি অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে, শত শত বছরের পুরনো ঘাগড়ালস্কর খানবাড়ী মসজিদ, মাই সাহেবা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদ আজও নিঃশব্দে বলে চলেছে সময়ের কাহিনি। আর শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গোপীনাথ ও অন্নপূর্ণা মন্দির সাক্ষ্য দেয় ধর্মীয় সহাবস্থানের ও স্থাপত্য-ঐতিহ্যের।
শেরপুরে নেই কোনো কৃত্রিমতা, আছে শুধু প্রকৃতির ছোঁয়া, ইতিহাসের গন্ধ আর সাদামাটা মানুষের উষ্ণ আতিথেয়তা। এ যাত্রা শুধু এক ভ্রমণ নয়, বরং আত্মার সঙ্গে প্রকৃতির বন্ধনের এক আবিষ্কার
গারো পাহাড়ের বুকে সবুজের মায়া
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা জেলার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গারো পাহাড়। ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার প্রায় বিশ হাজার একর জুড়ে এ পাহাড়ের উপস্থিতি যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার। বর্ষা এলেই সবুজে মোড়া পাহাড়গুলো যেন ফিরে পায় নতুন প্রাণ। ঝরনায় নেমে আসে জলরাশির উচ্ছ্বাস, জঙ্গলে ঘন হয় লতা-পাতার বাহার। চারদিক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক স্বপ্নময় সবুজ চাদর।
প্রকৃতিপ্রেমী কিংবা পাহাড়ের নীরবতায় হারিয়ে যেতে চাওয়া ভ্রমণকারীদের কাছে গারো পাহাড় এক আদর্শ গন্তব্য। এখানে রয়েছে শাল-সেগুনের বন, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, রহস্যময় ঝরনা, বনানী আর পাখির কলতান। রোদ আর ছায়ার খেলায় ভরা গারো পাহাড়ে হাঁটলে মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজেই আপনাকে গল্প শোনাচ্ছে সবুজের ভাষায়, নির্জনতায়, মুগ্ধতায়।
এখানে আকাশটা একটু বেশি নীল, বাতাসে মিশে থাকে পাখির কলতান আর নাম না জানা গাছেদের মৃদু গন্ধ। ঝিরিঝিরি ঝর্ণার শব্দ আর পাতার ফাঁকে উঁকি দেয়া রোদের ঝলকানি এক অপার্থিব আবেশে মোহিত করে যেকোনো পথিককে। গারো পাহাড় শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়- এ যেন নিসর্গপ্রেমীদের জন্য এক প্রার্থনার স্থান, প্রকৃতির নিঃশব্দ ভাষায় লেখা প্রেমপত্র।
গজনী অবকাশ কেন্দ্র
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা কাংশা ইউনিয়নে অবস্থিত গজনী অবকাশ কেন্দ্র যেন প্রকৃতি আর আধুনিক বিনোদনের এক অনবদ্য মেলবন্ধন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ বনানীর মাঝে এই পর্যটনকেন্দ্রটি বহু বছর ধরেই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন চোখ জুড়ায়, তেমনি মনেও গেঁথে থাকে বিনোদনের নানা আয়োজন। ঝুলন্ত সেতু, ভাসমান সেতু, কৃত্রিম ঝরনা, নৌকা ভ্রমণের লেক, ওয়াটার কিংডম, ক্যাবল কার, শিশু পার্ক, এমনকি একটি মিনি চিড়িয়াখানাও আছে এখানে।
এ যেন ছোটদের স্বপ্নের রাজ্য, বড়দের শৈশবের ফিরে পাওয়ার অনুভব। গজনীতে দিনের আলোয় প্রকৃতি আপন রূপে ধরা দেয়, আর বিকেল গড়িয়ে গেলে এখানকার স্মৃতি মুঠোবন্দি করতে মন চায় আরও কয়েকবার ঘুরে দেখতে। অসংখ্য দোকানে কেনাকাটা করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বাহারি খাবার, খেলনা ও হস্তশিল্প। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় বিকেল পাঁচটার মধ্যেই কেন্দ্রটি ত্যাগ করার নিয়ম থাকলেও তার আগ পর্যন্ত গজনী আপনাকে দেবে নিঃসন্দেহে এক পরিপূর্ণ আনন্দভ্রমণের অনুভব।
মধুটিলা ইকোপার্ক
গারো পাহাড়ের সবুজ কোলজুড়ে নালিতাবাড়ী উপজেলার শমশ্চূড়া বিটে বিস্তৃত মধুটিলা ইকোপার্ক যেন প্রকৃতির হৃদয় নিংড়ানো এক উপহার। চারদিক ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঘন বৃক্ষরাজির মাঝখানে অবস্থিত এই পার্কটি শুধু ভ্রমণপিপাসুদের নয়, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশপ্রেমীদের কাছেও এক স্বর্গীয় ঠিকানা। শেরপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ৪০ হেক্টর বনভূমির উপর গড়ে ওঠা এই ইকোপার্কে রয়েছে ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ারের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন চোখে পড়ে দিগন্তজোড়া সবুজ আর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের তুরা পাহাড়, তখন মনে হয় যেন পৃথিবীর বুকে এক নিখাদ স্বর্গে দাঁড়িয়ে আছি।
এখানে পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা সংকীর্ণ পথ, দূরে বুনো পাখির ডাক, আদিবাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া- সব মিলিয়ে এক অপার শুদ্ধতার অভিজ্ঞতা এনে দেয়। পার্কের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসস্থান, তাদের পরিপাটি মাটির ঘর আর সহজ-সরল জীবনযাপন যেন আরও গভীর করে তোলে এ স্থানটির সৌন্দর্য। মধুটিলা ইকোপার্ক তাই শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থানের এক স্পর্শকাতর নিদর্শন।
রাজার পাহাড়
সবুজে মোড়ানো, মেঘ ছোঁয়া উঁচু-নিচু টিলা আর নির্জনতার রাজ্য, সে অপার রূপেরই মহিমাময় প্রতীক রাজার পাহাড়। শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে অবস্থিত এ পাহাড়টি যেন গারো পাহাড়মালার এক গর্বিত অধিপতি। স্থানীয়দের দেওয়া ‘রাজার’ উপাধি শুধু নামেই নয়, গড়ন ও গৌরবেও এ পাহাড় সত্যিকারের রাজা। বিশাল সবুজ চূড়ার উপর সমতল ভূমি, তার ওপরে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশকে মনে হয় হাতছানি দেওয়া কোনো স্বপ্নপুরী। ঘন জঙ্গল, সরু বনপথ, আর বুনো পাখির ডাক মিলেমিশে এখানে গড়ে তোলে এক রূপকথার জগৎ।
পাহাড়চূড়ায় পা ফেললেই মনে হয়- নেমে এসেছেন প্রকৃতির অলৌকিক কোনো রাজ্যে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ে পাহাড়ি আদিবাসী সংস্কৃতির প্রাণ- বাবেলাকেনা কালচারাল অ্যাকাডেমি, যেখানে আছে তাদের জাদুঘর, পাঠাগার, গবেষণা বিভাগ ও মিলনায়তন। ইতিহাস আর সংস্কৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় রাজার পাহাড় হয়ে ওঠে শুধু পাহাড় নয়, এক জীবন্ত প্রেক্ষাগৃহ- যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও সময় একসঙ্গে মঞ্চস্থ করে তাদের নিজস্ব মহাকাব্য।
ঘাগড়ালস্কর খানবাড়ী মসজিদ
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর ঘাগড়ালস্কর গ্রামে গারো পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে মুঘল আমলের এক স্থাপত্য বিস্ময় খানবাড়ী মসজিদ। হিজরি ১০২৮ (ইংরেজি ১৬০৮) সালে নির্মিত এ মসজিদের দেয়ালে এখনো চোখে পড়ে প্রাচীন কারুকাজের ছাপ। একচিলতে গম্বুজ ঘেরা এ মসজিদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় দশটি মিনার, যেন ইতিহাসের নীরব পাহারাদার।
মসজিদের গাঁয়ের কারুকার্য দেখে ধারণা করা হয় মসজিদটি বক্সার বিদ্রোহী হিরঙ্গী খানের সময়কালে নির্মাণ করা হয়েছিল। আজিমোল্লাহ খান মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে অনুমান করা হয়। শতশত বছর আগের চুন-সুরকী দিয়ে অনুপম নির্মাণ শৈলীতে নির্মিত মসজিদটির বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মেরামতের কাজ করেছে।
চুন-সুরকির প্রাচীন নির্মাণশৈলী, দেয়ালের সূক্ষ্ম অলংকরণ আর স্থাপত্যরীতি একে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষণাধীন এ মসজিদ ইতিহাস ও স্থাপত্যপ্রেমী যেকোনো পর্যটকককে আকৃষ্ট করবে।
মাই সাহেবা জামে মসজিদ
শেরপুর শহরের কেন্দ্রস্থল বাগরাকসা মহল্লায় মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সৌন্দর্যের প্রতীক মাই সাহেবা জামে মসজিদ। ধারণা করা হয় আনুমানিক ২৫০ বছর আগে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটি ধর্মপ্রাণ নারী সালেমুন নেছা বিবির নামে পরিচিত।
ছোট থেকে ধীরে ধীরে তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল মসজিদে পরিণত হয়েছে যা একসঙ্গে ১০ হাজার মুসল্লি ধারণ করতে সক্ষম। মসজিদটির ভিতরে দেড় শতাধিক জানালা, ৬২টি গম্বুজ ও বহু দরজা রয়েছে। যা এর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে।
প্রতি শুক্রবারে দূর-দুরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন এই মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে। অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটকও মাই সাহেবা জামে মসজিদ দেখতে আসেন। মসজিদের নীচতলায় ওজুর ব্যবস্থা ও পৃথক পুরুষ-মহিলা নামাজের স্থান রয়েছে। ৯৫ ফুট উচ্চতার মিনার দুটি শহরের দূর-দূরান্ত থেকে দৃশ্যমান।
বারদুয়ারী মসজিদ
শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা ইউনিয়নের বারদুয়ারী মসজিদ শেরপুরের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ মসজিদের নির্মাণ কাল সম্পর্কে নিশ্চিত করে কেউই কিছু বলতে না পারলেও ধারণা করা হয় ১৫’শ শতকের কোনো এক সময় নির্মাণ করা হয় এ মসজিদটি। মুসলিম শাসকের পরাজয়ে পর প্রচন্ড ভূমিকম্পে মাটির নিচে তলিয়ে যায় এটি। কথিত আছে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪৫০ বছর এ মসজিদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাটির নিচে চাপাপড়া মসজিদের উপর বিশাল এক বটবৃক্ষ দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকায় অনুমান করা হয় এ মসজিদটি প্রায় ৪০০ বছর মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকে।
জনশ্রুতি আছে, ১৯৬০ দশকের দিকে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে বটগাছটি মূলসহ উপড়ে গেলে মসজিদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। পরে স্থানীয়দের সাহায্যে ভেঙ্গেপড়া বটগাছটি কেটে ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা মসজিদের সন্ধান পান। পরবর্তীতে মাটির নিচের মসজিদটির নকশা অক্ষুণ্ন রেখে সে ভিটির উপরেই আবারও নির্মাণ করা হয় এ মসজিদ।
মসজিদটির নাম এসেছে ১২টি দরজার কারণে। দৃষ্টিনন্দন মেহরাব, কার্নিশ ও কারুকার্য মসজিদটিকে বিশেষ করে তোলে। বর্তমানে পাঁচতলা ভবনে রূপান্তরিত ও প্রতি শুক্রবার দান থেকে লক্ষাধিক টাকা আসে।
গোপীনাথ ও অন্নপূর্ণা মন্দির
শেরপুর শহরের নারায়ণপুর এলাকায় শতাব্দী পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনন্য ধর্মীয় স্থাপনা গোপীনাথ ও অন্নপূর্ণা মন্দির। ১৭৮৩ সালে জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ও জ্ঞানেন্দ্র মোহন চৌধুরীর হাতে গড়া এ মন্দির শুধুই একটি পূজাস্থল নয়, বরং এটি এ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্য ও নান্দনিক স্থাপত্যরীতির এক জ্যান্ত দলিল।
পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট এ মন্দিরটির প্রতিটি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে পদ্মফুল-আকৃতির নকশায়, যা পুরনো বাংলার মন্দির নির্মাণশৈলীর এক পরিপূর্ণ উদাহরণ। কার্নিশ ও জানালাগুলোর উপরের সূক্ষ্ম লতাপাতা ও ফুলের কারুকাজ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় অলংকরণগুলো, যেন দেবতার আশীর্বাদেই তারা জ্বলে ওঠে নতুন আলোয়।
অন্নপূর্ণা অর্থাৎ অন্নের দেবী ও গোপীনাথের প্রতি নিবেদিত এ মন্দির এখনো স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয়। প্রতি বছর এখানে দুর্গাপূজা ও অন্নপূর্ণা পূজায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা দেখতে ছুটে আসেন অনেক ভক্ত ও পর্যটক। শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, ইতিহাস, স্থাপত্য আর সৌন্দর্যপিপাসুদের জন্যও গোপীনাথ-অন্নপূর্ণা মন্দির হতে পারে একটি মননশীল ভ্রমণ গন্তব্য। প্রাচীন বাংলার সৌন্দর্য আর বিশ্বাসের মেলবন্ধনে দাঁড়িয়ে থাকা এ মন্দির যেন সময়কে ছুঁয়ে দেখার একটি নিঃশব্দ সুযোগ।
কোথায় থাকবেন, কী খাবেন?
শেরপুর ভ্রমণে দিনভর প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে যখন ক্লান্ত শরীর একটু বিশ্রাম চায়, তখন থাকার ভালো ব্যবস্থা পেলে আনন্দ দ্বিগুণ হয়। শেরপুর জেলা শহরে রয়েছে পর্যটকদের জন্য মানসম্মত কিছু আবাসিক হোটেল। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল সম্পদ, হোটেল আয়সার ইন, পার্কভিউ ইন ও হোটেল হেরিটেজ অব শেরপুর, এসব হোটেলে এসি ও নন-এসি কক্ষ রয়েছে, যেখানে আপনি এক রাত কাটাতে পারবেন মাত্র ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।
তবে যদি আপনি তুলনামূলক সাশ্রয়ী বাজেটের মধ্যে থাকতে চান, তাহলে শহরের অন্যান্য আবাসিক হোটেল যেমন: হোটেল অবকাশ, হোটেল ফ্রিডম, কিংবা হোটেল আরাফাত হতে পারে ভালো পছন্দ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে আরামদায়কভাবে রাত কাটাতে পারবেন এই হোটেলগুলোতেও।
জেলা শহরের বাইরে, বিভিন্ন উপজেলায় রাত্রি যাপনের তেমন ভালো বেসরকারি হোটেল না থাকলেও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো রয়েছে। সেখানে থাকতে হলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে বুকিং করে রাখতে হবে।
ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে অবশ্যই চাই ভালো খাবার। শেরপুর শহরে বেশ কিছু মানসম্মত রেস্তোরাঁ রয়েছে যেখানে আপনি রুচিসম্মত ও স্বাস্থ্যকর খাবার উপভোগ করতে পারবেন।
খাবারের জন্য জনপ্রিয় কিছু রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে- হোটেল শাহজাহান, স্টার রেস্টুরেন্ট, হোটেল নিউ আলিশান। চাইনিজ খাবারের ভক্তদের জন্য রয়েছে- সম্পদ চাইনিজ, ইনভাইট, থাই-চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। আর যদি আপনি একটু সাধ্যের মধ্যে খেতে চান, তাহলে যেতে পারেন- হোটেল আহার, জি-৭, হোটেল শুভ, হোটেল মান্নান
আর হ্যাঁ, শেরপুরে এসে ভালো মানের ছানার পায়েস খেতে ভুলবেন না। এটি এখানকার একটি জিআই পণ্য (ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য), যা শেরপুরের ঐতিহ্য ও স্বাদের পরিচায়ক। ছানার পায়েস না খেয়ে ফিরে গেলে আপনার শেরপুর ভ্রমণ যেন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে!
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে শেরপুর যাওয়া এখন অনেক সহজ ও আরামদায়ক। রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ছেড়ে যায় শেরপুরগামী বাস। আপনি চাইলে সোনার বাংলা বা অন্যান্য লোকাল সার্ভিস বাসে যাত্রা করতে পারেন, যেখানে জনপ্রতি ভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা।
আর যদি আপনি একটু আরামদায়ক ভ্রমণ পছন্দ করেন, তাহলে মহাখালী বা বায়তুল মোকাররম মার্কেট এলাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া এসি/নন-এসি গেইটলক বাসগুলো হতে পারে দারুণ পছন্দ। এসি বাসে যাত্রা করলে ভাড়া একটু বেশি হলেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সুবিধা পাবেন।
ঢাকা থেকে শেরপুরের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। স্বাভাবিক সময়ে ভ্রমণ করতে সময় লাগবে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। তবে রাস্তায় যানজট বা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে সময় কিছুটা বাড়তেও পারে।
শেরপুর শহরে পৌঁছানোর পর গন্তব্যভেদে অটো-রিকশা, সিএনজি বা ত্রি-চক্রযানে চড়ে যেতে পারবেন জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে। নিচে কিছু জনপ্রিয় গন্তব্যে যাওয়ার উপায় তুলে ধরা হলো:
গজনী অবকাশ কেন্দ্র (ঝিনাইগাতী): গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যেতে হলে প্রথমে শেরপুর শহর থেকে অটোরিকশায় করে খোয়ারপাড় মোড় যেতে হবে। এরপর খোয়ারপাড় মোড় থেকে সিএনজি বা অটোরিকশা রিজার্ভ করে সরাসরি পৌঁছানো যায় গজনী অবকাশ কেন্দ্রে। এই রিজার্ভ ভাড়া সাধারণত সারা দিনের জন্য ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে পড়ে।
মধুটিলা ইকোপার্ক (নালিতাবাড়ী): মধুটিলা ইকোপার্কে যাওয়ার পদ্ধতিও গজনীর মতোই। খোয়ারপাড় মোড় থেকে সিএনজি বা অটোরিকশা রিজার্ভ করে আপনি সহজেই মধুটিলায় পৌঁছে যেতে পারেন। এখানে ঘোরাঘুরির জন্য দিনব্যাপী রিজার্ভ ভাড়াও প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকার মতো হয়।
ঘাগড়ালস্কর খানবাড়ী মসজিদ (ঝিনাইগাতী): এই ঐতিহাসিক মসজিদটি শেরপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যাতায়াতের জন্য খোয়ারপাড় মোড় থেকে সিএনজি বা অটোরিকশা রিজার্ভ করা যায়। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে আনুমানিক ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
রাজার পাহাড় (শ্রীবরদী): রাজার পাহাড় ভ্রমণে প্রথমে শেরপুর শহর থেকে সিএনজিতে করে শ্রীবরদী বাজার যেতে হবে, যার জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৪০ টাকা। এরপর শ্রীবরদী বাজার থেকে রিজার্ভ সিএনজি বা অটোরিকশায় রাজার পাহাড়ে যাওয়া যায়। এ অংশের ভাড়া নির্ভর করে দূরত্ব ও সময়ের ওপর, তবে দলবেঁধে গেলে খরচ কিছুটা সাশ্রয়ী হয়।
বারদুয়ারী মসজিদ (গড়জরিপা, শ্রীবরদী): শেরপুর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মসজিদে যেতে হলে অটোরিকশা বা সিএনজি ব্যবহার করতে হবে। রিজার্ভ না করেও অটোরিকশায় যাওয়া সম্ভব, যেখানে ভাড়া পড়বে আনুমানিক ১২০ থেকে ১৫০ টাকা।
টিপস: আপনি যদি একদিনে একাধিক স্থান ঘুরে দেখতে চান, তাহলে দলবেঁধে একটি সিএনজি রিজার্ভ করে নেয়া সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। এতে সময় বাঁচে, খরচও কম পড়ে।
আপন দেশ/এমবি