
সংগৃহীত ছবি
ইসরায়েলি কারাগারে গাজার বন্দীদের উপর নৃশংস নির্যাতন চলছে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের মর্মান্তিক বর্ণনা দিয়েছেন এক ফিলিস্তিনি আইনজীবী।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বন্দী বিষয়ক কমিশনের আইনজীবী খালেদ মাহাজনা সম্প্রতি আনাদোলু এজেন্সিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, ইসরায়েল যৌন সহিংসতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের দমন করতে পরিকল্পিতভাবে যৌন নির্যাতন করছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
মাহাজনা বলেন, এক ফিলিস্তিনি পুরুষ বন্দীকে কারাগারের উঠোনে এনে শিকল পরা অবস্থায় উলঙ্গ করা হয়। একজন নারী কারারক্ষী তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপের সঙ্গে ধর্ষণ করে।এটি শুধু ধর্ষণ ছিল না। এটি ছিল পরিকল্পিত অপমান ও মানসিক ভেঙে পড়ার একটি অংশ। এতে এমন পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে যা বর্ণনার অযোগ্য।
মাহাজনা বলেন, এ যৌন নির্যাতন ছিল ২০০৪ সালের ইরাকে মার্কিন বাহিনীর কুখ্যাত আবু গারিব কেলেঙ্কারির চেয়েও ভয়াবহ।
ইসরায়েলের কুখ্যাত কারাগার ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর নির্যাতন
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল তার পুরোনো ও বন্ধ করে দেয়া কিছু ভূগর্ভস্থ বন্দিশালা আবার চালু করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রামলার আয়ালন কারাগারের কুখ্যাত রাকেফেট স্থাপনা। এটি ১৯৪৮ সালে তৈরি হলেও বসবাসের অযোগ্য বলে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
মাহাজনার জানায়, শত শত গাজাবাসী, এমনকি লেবানিজ ও সিরীয় নাগরিকদেরও অমানবিক পরিবেশে রাকেফেটে আটকে রাখা হয়েছে। ছয়জনের জন্য তৈরি ছোট কক্ষে ২৫ জন পর্যন্ত বন্দীকে রাখা হয়। তাদের পর্যাপ্ত খাবার বা কম্বল দেয়া হয় না। মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়। দিনের আলো থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আইনজীবীরা খুবই সীমিত সংখ্যক বন্দীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তবে প্রতিটি সাক্ষাৎকারই যেন এক যুদ্ধের মতো। কারারক্ষীদের কড়া নজরদারিতে বন্দীরা ভয়ে তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের কথা বলতে পারেন না।
যৌন নির্যাতন ও বর্বরতা
মাহাজনা জোর দিয়ে বলেছেন যে বন্দীদের ওপর নির্যাতন করা হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য নয়, বরং শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে। ইসরায়েলি সরকার কারারক্ষীদের গাজার বন্দীদের সঙ্গে যেকোনো কিছু করার সবুজ সংকেত দিয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো নির্যাতন ও অপমান করা, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নয়। এ বর্বরতার মধ্যে বিশেষভাবে যৌন নির্যাতন উল্লেখযোগ্য।
মাহাজনা গাজার নারী বন্দীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন, যেখানে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও জোরপূর্বক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পুরুষ বন্দীরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। উদাহরণস্বরূপ, একজন বয়স্ক গাজার বন্দীকে বেঁধে, বিবস্ত্র করে তার শরীরে লাঠি ঢুকিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। কারারক্ষীরা এ ঘটনার ভিডিও করে নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে গর্ব করত। আরেকজন ক্যান্সার আক্রান্ত যুবককে পরিষ্কার পানি চাওয়ায় টেনে নিয়ে টয়লেট থেকে পানি পান করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
আশ্চর্যজনকভাবে, ইসরায়েলি ডাক্তাররাও এ নির্যাতনে জড়িত। মাহাজনা এমন একজন বন্দীর কথা বলেছেন যার হাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই কেটে ফেলা হয়েছিল। কারণ কয়েক মাস ধরে শিকল পরিয়ে রাখায় তার হাতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। একই কারণে অন্য বন্দীরাও মারা গেছে।
ইসরায়েলের নির্যাতন, বিশ্ব ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি বার্তা
মাহাজনার মতে, ইসরায়েল ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চায়। প্রথমত, এটি বিশ্বের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এর মাধ্যমে ইসরায়েল বোঝাতে চায় যে তারা মানবাধিকার সংস্থা বা আন্তর্জাতিক আদালতের কোনো তোয়াক্কা করে না।
দ্বিতীয়ত, এটি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভীতি ছড়াতে চায়। যারা ইসরায়েলের বিরোধিতা করবে, তাদের অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হবে। পুরো প্রজন্মকে ভেঙে দেয়া হবে—এই বার্তাই দেয়া হয়।
মাহাজনা আরও উল্লেখ করেছেন যে, ২০০২ সালে পাস হওয়া ‘বেআইনি যুদ্ধ আইন’ নামে একটি কুখ্যাত আইন বছরের পর বছর ধরে অব্যবহৃত থাকলেও ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এটি আক্রমণাত্মকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ আইনের অধীনে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি লেবানিজ ও সিরীয় নাগরিকদেরও কোনো অভিযোগ ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখতে পারে। তিনি জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বিচার বা অভিযোগ ছাড়াই আটক করেছে। যার মধ্যে ৫০০ শিশুও রয়েছে।
মৃত্যু শিবির: বিচারহীনতা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
মাহাজনা বলেছেন যে, ইসরায়েলি আদালতে পদ্ধতিগত বাধা সত্ত্বেও তার দল অভিযোগ ও আপিল দায়ের করে চলেছে। বন্দীদের মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হচ্ছে; কিছু বন্দী মাসের পর মাস ধরে তাদের অন্তর্বাস পরিবর্তন করেননি। ইসরায়েলি আদালতও নির্যাতনের একটি অংশ।
তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আদালতে সম্ভাব্য দেয়ানি মামলার ভয় পায়, বিশেষ করে যারা যৌন সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মুক্তি পেয়েছেন, তাদের কাছ থেকে। মাহাজনা দক্ষিণ ইসরায়েলের কুখ্যাত সদে তেইমান শিবিরে গাজার একজন বন্দীর ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত পাঁচজন ইসরায়েলি সৈন্যের মামলার কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, অভিযুক্ত সৈন্যরা মুক্ত অবস্থায় বিচার পাচ্ছে। সম্ভবত হালকা শাস্তি পেয়ে মুক্তি পেয়ে যাবে।
মাহাজনা একটি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, আমি যাদের সঙ্গে দেখা করি তাদের প্রত্যেকেই আমাকে একই কথা বলে: এ মৃত্যু শিবির থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।