
ছবি: আপন দেশ
দিন যায় মাস যায়, বছরের পর বছর চলে যায় কিন্তু আয় বাড়ে না। তবে ব্যায় বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুন। আজ সবজির দাম বেশি তো পরশু ডিমের দাম বাড়তি। আমরা তো বড় মাছ, মুরগি কিম্বা মাংস কিনতে পারি না। সবজি আর ডিম খেয়ে কোনো রকমে দিন পার করি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এগুলোর দামও বেড়েছে। কিন্তু সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে চললে তো আমরা না খেয়ে মরব। কথগুলো বলছিলেন বেসরকারি একটি কোম্পানির চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলম।
তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় রাজধানীর কমলাপুর কাঁচাবাজারে। বাজারে প্রায় সব পণ্যের উচ্চমূল্যে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। জাহাঙ্গীরের মত আরোও অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ বাজার করতে গিয়ে দিশাহারা। প্রতিটি সবজির দাম বেশি। ডিমের হালি ৫০ টাকায় ঠেকেছে। পেঁয়াজ-কাঁচামরিচের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আরও সঙ্কটে পড়বে মধ্যবিত্তরাও।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার (০৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্রদেখা গেছে। মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। মানুষের আয় না বাড়লেও এভাবে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। এক দিক সামাল দিতে গিয়ে টান পড়ছে আরেক দিকে। অনেকটাই হাঁসফাঁস অবস্থা।
মধ্যবিত্ত লজ্জায় কিছু না বললেও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা আরো করুণ। তারা রীতিমতো সংগ্রাম করছে জীবনযুদ্ধে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত দুই মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজ, ডাল, মুরগির ডিম, সোনালি মুরগি, মাছ ও কয়েকটি সবজির দাম সর্বোচ্চ ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে এখন বাজারে মানুষের অসহায় দৃষ্টি চোখে পড়ে। সাধারণ মানুষ আসলে কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা এক রকম কথা বলেন, আবার আড়তদাররা বলেন আরেক রকম। ক্রেতাদের কথা শোনার কেউ নেই।
এদিন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিকেজি বেগুন ৮০-১২০ টাকা, টমেটো ১২০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা, ধুন্দল ৫০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, পটল ৭০ টাকা, কচুর মুখী ৬০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, শসা ৬০-৮০ টাকা ও পেঁপে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বরবটি ১০০-১২০ টাকা, কহি ৬০ টাকা, গাজর ৭০-৯০ টাকা, ঝিঙে ৫০-৬০ টাকা, পেঁয়াজ ৭৫-৮০ টাকা, শিম ১৬০ টাকা, মুলা ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, আলু ২৫ টাকা, ধনেপাতা ৮০ টাকা, কাঁচা আমড়া ৫০ টাকা ও উচ্ছে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন<<>>নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির, বিপাকে স্বল্প আয়ের মানুষ
আর প্রতি পিস চালকুমড়া ৫০-৬০ টাকা ও প্রতি পিস লম্বা লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম ১৬০ টাকা। প্রতি মুঠো লাউ শাক ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও পুঁইশাক ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি আঁটি ডাঁটাশাক ২০ টাকা, কলমি শাক ১০-১৫ টাকা, লালশাক ১০-১৫ টাকা ও পাটশাক ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বিক্রেতারা বলছেন, গত কয়েক মাসে টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকের সবজিক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে বাজারে সরবরাহ কমায় দাম বাড়ছে। সবজির দাম বেশি হওয়ার কারণে বাজারে সবজির বিক্রিও আগের তুলনায় কমে গেছে। এতে আমরা এখন লোকসানে রয়েছি।
বাজার করতে আসা আল মামুন বলেন, বাজারে আসলে মনে হয় সবজিতেই বেতনের সব টাকা শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি সবজির দাম চড়া। দামের চাপে মধ্যম আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। পরিমাণেও কম কিনতে হচ্ছে। আমরা বাজারে স্বস্তি চাই।
কিছুদিন ধরে কাঁচামরিচের দাম বাড়তি। বর্তমানে বাজারে ২২০ থেকে ২৬০ টাকার মধ্যে এক কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে। ট্যারিফ কমিশন কাঁচামরিচের বাজারদর ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া কাঁচামরিচ আমদানির সময় শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের পরিবর্তে প্রকৃত বিনিময়মূল্য শুল্কায়নের সুপারিশও করা হয়েছে।
এদিকে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৮০ টাকার মধ্যে। সোনালি মুরগি পাওয়া যাচ্ছে ৩২০-৩৩০ টাকা কেজি দরে। আগের সপ্তাহেও একই দামে এগুলো বিক্রি হয়েছে। মুরগির ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪৮-১৫০ টাকা দরে।
বিক্রেতারা বলছেন, ডিমের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় ডজনে ৫ টাকা কমেছে। তবে এক হালি ডিম কিনলে ক্রেতাদের ৫০ টাকাই গুনতে হচ্ছে। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে দাম আগের মতোই রয়েছে।
তবে গরু ও খাসির মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৬০-৮০০ টাকা, খাসির মাংস ১ হাজার ২০০ টাকা ও ছাগলের মাংস ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আরও পড়ুন<<>>সবজি-ডিমের চড়া দামে দিশেহারা স্বল্প আয়ের মানুষ
বাজারে গত সপ্তাহের তুলনায় কমেছে রুপালি ইলিশের দাম। কেজিতে ৩০০-৪০০ টাকা কমে বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২২০০ টাকায়। এছাড়া দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ টাকা, ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৯০০ টাকা ও ৬০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৬৫০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।
অন্যান্য মাছের দাম রয়েছে আগের মতোই চড়া। প্রতিকেজি বোয়াল ৭৫০-৯০০, কোরাল ৮০০-৮৫০, আইড় ৭০০-৮০০, চাষের রুই ৩৮০-৪৫০, কাতল ৪৫০, তেলাপিয়া ১৮০-২২০, পাঙাশ ১৮০-২৩৫ এবং পাবদা ও শিং ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চাষের ট্যাংরা ৭৫০-৮০০, কাঁচকি ৬৫০-৭০০ এবং মলা ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানি বেশি হলেও পেঁয়াজের দামে সেভাবে কমেনি। এখনো খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে। যদিও কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজের দাম রাখা হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা। যেখানে দেশি পেঁয়াজ ৬৫-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতা হাবিব বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ-মরিচের দামও বেশি। ফলে এ আমদানি দাম কমায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। তবে বাজারে রসুনের দাম কিছুটা কমেছে। প্রতি কেজি আগে ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১৫০-১৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
চালের বাজারে কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চালের দাম এখনো বাড়তি। অবশ্য গত দুই সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে এক–দেড় টাকা কমেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট ৭২-৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতি কেজি নাজিরশাইলের দাম ৭৫-৯৫ টাকা। এছাড়া ব্রি-২৮ চাল ৬২ টাকা ও মোটা ধরনের স্বর্ণা চাল ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার করতে আসা অটোরিকশা চালক ফারুক জানান, এক বেলায় তার ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। এ পুরো টাকা দিয়েও একদিনের বাজার হয় না। চাল-তেল কেনার পর মাছ বা মাংস কিনতে গেলে সবজি নিতে পারেন না। যে দিন আবার পেঁয়াজ, আদা বা রসুন লাগে, ওই দিন মাছ কিংবা মাংস কেনা যায় না। এভাবে টেনেটুনে কত দিন চলা যায়?
বাজার পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, বাজারের সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থায় একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কম দামে পণ্য কিনে তা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। এ প্রক্রিয়ায় কৃষকের খরচ তুলতে কষ্ট হলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই তাদের অতিমুনাফার অংশটি লুটে নিচ্ছে।
জানা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্যের দাম যতটা কম, তার কয়েক গুণ বেশি খুচরায়। মাঝখানে খুব একটা দর বাড়া বা খরচ না হলেও নানা অজুহাতে খুচরায় কয়েক গুণ বেশি দাম নেয়া হয়। ভোক্তারা বলছে, এ চক্র ভাঙতে হবে সবার আগে। এটি কঠিন না হলেও তা করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।