
ছবি: আপন দেশ
জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবে অতি বর্ষণ, তীব্র খরা-তাপদাহ,সাগর-নদীর মোহনায় অসংখ্য ডুবো চর আর অস্বাভাবিক দূষণের কারণে ভরা মৌসুমে জেলেদের জালে মিলছে না কাঙ্খিত ইলিশ। এর ফলে এ পেশার সঙ্গে জড়িত জেলে- আড়তদারসহ লাখ লাখ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। ইলিশের রাজ্যখ্যাত সাগর পাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে ইলিশের চরম আকাল চলায় দাম আকাশচুম্বী। নাগালের বাইরে ইলিশের দাম থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখন প্রায় রূপালী ইলিশের স্বাদ ভুলতে বসেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাপক প্রভাব পড়বে এ মৎস্য সম্পদ আহরণে। কর্মহীন হয়ে পড়বে এ পেশার সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষ।
মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ লোনা পানির মাছ হলেও ডিম ছাড়ার সময় মিঠা পানিতে চলে আসে। এ সময় ইলিশের প্রয়োজন হয় অনুকূল পরিবেশ। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনে তা মারাত্নকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সাগরে অস্বাভাবিক জলোচ্ছাস, তীব্র তাপদাহ, ডুবো চর,নদীর নাব্যতা হ্রাস, নদী দূষণ ও অসংখ্য বেহেনতি ও বাধাজাল দিয়ে ইলিশের মাইগ্রেশানে মারাত্মকভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। একটি মা ইলিশ ১৫/২০ লাখ ডিম ধারণ করে প্রজননকালীন সময়ে পটুয়াখালীর তেতুলিয়া, রামনাবাদ, আগুনুখা, বুড়অগৌরঙ্গ, আন্ধারমানিক ও পায়রা-বিষখালীর অভায়াশ্রমে আসতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়।
আবার ডিম ছাড়া শেষে সাগরে ছুটতেও একি অবস্থা। এছাড়া নদ-নদীর মিঠা পানিতে মা ইলিশের পোনা বছরজুড়ে ধ্বংস করা হয় বিভিন্নভাবে। এসব ইলিশের ঝাটকা পরিপূর্ণ ইলিশ হতে সাগরের লোনা পানিতে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাগর-নদী মোহনায় জেগে উঠা ডুবোচর ও বাধাজাল ও কারেন্ট জাল। ছোট থাকতেই ঝাটকা ইলিশ মারা পড়ে এসব জালের কারণে। শুধু ঝাটকা বা ছোট ইলিশ না অন্যান্য প্রজাতির মাছও মারা যায়।
আরওপড়ুন<<>>খাগড়াছড়িতে মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা
কলাপাড়ার সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের প্রধান মাঝি খলিল উদ্দিন সম্প্রতি জানান, ভারত ও মিয়ানমারের পতাকাবাহী শতাধিক অত্যাধুনিক জাহাজ সব সময় সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে রয়েছে ২০-২৫টি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। এসব ট্রলার থেকে যান্ত্রিক উপায়ে এক ধরনের জাল ফেলা হয় সাগরে। এগুলো লাশা জাল নামেও পরিচিত। তিন স্তরের ওই জাল ভেদ করে ছোট-বড় কোনো ইলিশই সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগরে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে খালি হাতে তাদের ঘাটে ফিরতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, লোকসানের মুখে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ উপকূলের জেলেরা। এ কারণে বর্ষার ভরা মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের জালে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা মিলছে না। দিন দিন তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। আর অল্প পরিমাণ মাছ বাজারে পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশচুম্বী। বর্তমানে ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ফলে কেজিপ্রতি দাম ১৭শ' থেকে ২৮শ' টাকা। আবার দুই কেজি বা তার চেয়ে বড় ইলিশের দাম আরও বেশি ।
পটুয়াখালীর নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে ইলিশ কিনতে আসা এক ক্রেতা জানান, পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানের জন্য ১ কেজি ২২ গ্রামের ২ টি ইলিশ নিলাম ৪ হাজার ৬শ' টাকায়। তিনি বলেন, এ বাজারে ৭/৮ বছর আগেও আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে প্রতিদিন মণে মণে ইলিশ উঠত। অথচ এখন ইলিশই নেই। তারপর নানা হাত পেরিয়ে সিন্ডিকেটের কারণে দাম এতা বেশি হয় যে, ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মৎস্য বন্দর মহিপুর- আলীপুর। এ দুই বন্দরের জেলেরা জানান, ইলিশ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে।
আরওপড়ুন<<>>বাবা-মায়ের সামনে ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা!
মহিপুর মৎস্যবন্দর আড়ৎদার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমন দাস জানান, অস্বাভাবিক বৃষ্টি,ও অতিখরা, নদীতে ফেলানো মায়লা সাগরের তলদেশে জমে অক্সিজেনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেজন্য সাগরের উপরিভাগে মাছের বিচরণ কমে যাওয়ায় তীরে ইলিশ খুবই কম আসছে। এসব কারণেই আজ ইলিশের এতো সংকট।
গলাচিপার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জহিরুন্নবী বলেন, উপকূলজুড়ে ডুবোচর, নদীর মোহনা ভরাট, নদী দুষণ, আবহাওয়ার বৈরিতা ও জেলের সংখ্যা বাড়ায় ইলিশের স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করে অন্যদিকে চলে যাওয়ায় এ মাছের পরিমাণ কমছে বলে ধারণা তার।
মতস্য বিশেষজ্ঞদের মতে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও তীব্র তাপপ্রবাহ সমুদ্রের জলস্তরকে মিসতে বাধার সৃষ্টি করায় সমুদ্রের উপারিভাগে পুষ্টি সরবরাহ হয় না যা প্লাস্কট ব্যাগাত সৃষ্টি হয়। এতে সমূদ্রের খাদ্যচক্র বিপর্যস্ত হয়। যার জন্য ইলিশ হ্রাস দিনদিন বাড়ছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলে সুজন আকন বলেন, নিষেধাজ্ঞা নেই, তবে সাগর উত্তাল। ঘন ঘন সিগন্যাল থাকায় সাগরে গিয়ে জেলেরা টিকতে পারে না। তাছাড়া সাগরেও চাহিদামতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এক একটি বোট নিয়ে সাগরে যেতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকার মালামাল প্রয়োজন হয়। সে টাকা উঠবে কি-না, তার নিশ্চয়তা না থাকায় হতাশ ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িতরা।
মহিপুর ও আলীপুর মৎস্য বন্দর ঘুরে দেখা গেছে, ৪শ’ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশের দাম ৬৮ থেকে ৭০ হাজার, ৮-৯শ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ টাকা, এক কেজির বেশি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ ৭ থেকে এক লাখ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় আকারের ইলিশের দাম গত ১০ দিনের ব্যবধানে মণপ্রতি ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে ।
আপন দেশ/এমএইচ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।