Apan Desh | আপন দেশ

লুটের রাজা লজিং মাস্টার ফখরুল এখন বায়রার সাধু!

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২১:৪৮, ৬ মে ২০২৫

আপডেট: ২২:১১, ৬ মে ২০২৫

লুটের রাজা লজিং মাস্টার ফখরুল এখন বায়রার সাধু!

মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম।

মো. ফখরুল ইসলাম। ছাত্রাবস্থায় ছিলেন লজিং মাস্টার হিসেবে পরিচিত। শিক্ষা শেষের পর যিনি ছিলেন রিক্রুটিং জগতের ‘কমিশন কাণ্ডারি’, প্রবাসী শ্রমিকদের ঘামে ভেজা টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রাসাদ আর প্রভাব—আজ তিনিই বায়রার সভায় নীতির ফেরিওয়ালা! ভিসা বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়া ফখরুল ইসলাম এখন নিজেকে বানিয়েছেন `জনসেবক`! 

লুটের রাজা এখন সাধুর খোলসে—এটাই বায়রার আজকের মহান নাটক! সাধুত্বের এমন নিদর্শন দেখলে শয়তানও অবাক হয়!

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ করার জন্য ভয়ানক অপতৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) বহিষ্কৃত কিছু নেতা। এ চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করছেন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফকরুল ইসলাম।

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার মধ্যে নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণসহ শ্রমবাজার সম্প্রর্কিত তৃতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২১-২২ মে অনুষ্ঠিত হবে। এর আগেই ফখরুল দেশবিরোধী অপতৎপরতায় নেমেছেন। দেশের রেমিট্যান্স শার্টডাউন করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করাই যেনো তার টার্গেট। তার এমন অপতৎপরতায় মালয়েশিয়ায় আগামী ৬ বছরে প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানো অনিশ্চিত হতে চলেছে। এতে বাংলাদেশ বছরে কয়েক বিলিয়ন রাজস্ব হারানোর শংকা তৈরি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন<<>> মোরশেদ আলমের ‘শরীয়াহ ভিত্তিক’ দুর্নীতি! ন্যাশনাল লাইফের শতকোটি লুট

জানা গেছে, এভিয়েটর ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারী নূরুল আমিনের বাসায় লজিং মাস্টার ছিলেন ফখরুল ইসলাম। পরে তার মাধ্যমে জনশক্তি রফতানিতে জড়িত হয়ে পরে সে নিজেই জনশক্তি রফতানি খাতের গডফাদার বনে যান। ফাঁসিয়ে দেন নিজের মালিককে। ভিসা জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার হাতানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। রাজধানীর বারিধারায় তৈরি করেছে ১০তলা ভবন। নিজ এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। যার পরিমাণ অন্তত: হাজার কোটি টাকা।

তার নিজ এলাকা ফেনীর বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেন আপন দেশকে বলেন, শ্রমিকের রক্ত চুষে বিলাসী জীবনযাপন করছে ফখরুল ইসলাম। সে এলাকায় যায় গাড়ি বহর ও সশস্ত্র দেহরক্ষীসহ। আওয়ামী লীগের বড় অর্থদাতা ফখরুল এখন নিজেকে জামায়াত নেতা হিসেবে জাহির করার অপচেষ্টা করছে। 

জানা গেছে, জনশক্তি রফতারি খাতকে বিতর্কিত করতে সম্প্রতি ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে নিউ ইস্কাটন রোডে বায়রার অফিসে হামলা, ভাংচুর চালানো হয়।

বায়রা অফিস থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত ২০ এপ্রিল দুপুর ২টা ১০ মিনিট নাগাদ দুর্বৃত্তরা বায়রা অফিসে হামলা করে। তারা সভাপতি ও মহাসচিবের কক্ষের নেমপ্লেট খুলে নেয়। আসবাব ভাংচুর করে ও কিছু কিছু আসবাবপত্র লুট করে। ওই হামলা, ভাংচুরে নেতৃত্ব দেন বায়রার বহিষ্কৃত যুগ্ম মহাসচিব ও হিউম্যান রিসোর্স লিমিটেডের ম্যানেজিং পার্টনার ফখরুল ইসলাম। এর আগে ফখরুলের অপতৎপরতার বিষয় নজরে আনতে পল্টন থানায় জিডি করেন এসএফ গ্লোবাল লিমিটেডের এমডি হাওলাদার ফোরকান উদ্দিন। 

জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের এআএল-৪৫২। বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ বাড়িতে থাকা এ প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম পতিত আওয়ামী লীগের ডোনার, একজন দোসর। 

ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশের জনশক্তি রফতানি খাতকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে আসছেন। সঙ্গে আছে আরও কয়েকজন। এর ধারাবাহিকতায় ফখরুল ইসলাম মালয়েশিয়ান তিনজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাদের তিনজনই জনশক্তি আমদানি-রফতানি ব্যবসায় জড়িত। তাদেরকে গোপনে মালয়েশিয়ান সরকারি প্রতিনিধি সাজিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিগণকে সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয় দেন। বাংলাদেশে দূতাবাসের কোনো অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশে এসে অনাধিকার চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতারিকারকদের বিষয়ে অবৈধভাবে খোঁজ খবর নেন। ওই ব্যক্তিরা ফখরুলের বাংলাদেশ থেকে মালেশিয়ায় জনশক্তি রফতানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নানান অপতৎপরতা চালান। 

বাদী আশংকা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে মালেশিয়া শ্রম বাজারকে বাধাগ্রস্ত এবং ড. ইউনূস সরকারকে বৈদেশিক শ্রম বাজারে অস্থিরতায় ফেলতে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ফখরুলকে সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে একটি অভিযোগ জমা হয়েছে।

আরও পড়ুন<<>> ব্যাংক লুটছেই নোমান গ্রুপ

ওই অভিযোগে বলা হয়, পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বাণিজ্যে ১০ সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিলেন ফখরুল ইসলাম। মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাণিজ্যের জন্য বাগিয়ে নিয়েছেন নিজের মেডিক্যাল সেন্টার ওয়েলকাম মেডিক্যাল। প্রায় ৭০ হাজার কর্মীর নামমাত্র স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। 

তিনি পরিচয় লুকিয়ে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তার কমপক্ষে দুইটি লাইসেন্স রয়েছে, ১০১ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়। সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকাতেও রয়েছে তার এজেন্সি ও ওয়েলকাম মেডিক্যাল সেন্টার। ১০১ সিন্ডিকেটভুক্ত ফখরুল ইসলামের বেনামী প্রতিষ্ঠান ছিল ত্রিবেনি ইন্টারন্যাশনাল ও সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানায় অন্য ব্যক্তির নাম থাকলেও যার নেপথ্য মালিক ও অংশীদার ফখরুল ইসলাম। তিনি নিজের লাইসেন্স সরাসরি ব্যবহার না করে অন্যের নামে ব্যবসা করছেন। অন্য যারা ব্যবসা করেন তাদের লাইসেন্স ছিল একটি। আর ফখরুল ব্যবসা করেছেন দুই লাইসেন্সে। তাছাড়া অন্য ব্যবসায়ীরা মূল ১০১ এজেন্সির মধ্যে অথবা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ছিলেন। আবার অনেকে ছিলেন শুধু মেডিক্যাল সেন্টার ব্যবসায়। কিন্তু ফখরুলই একমাত্র ব্যক্তি; যার গায়ে কোনো গরম বাতাস লাগেনি। 

ফেনী জেলার দাগন ভূঁইয়ার বাসিন্দা আলমাস বলেন, আমি দুবাই যাওয়ার জন্য ফখরুলের বারিধারার অফিসে দুই লাখ টাকা জমা দিয়েছি। আমাকে দুই বছরেও ভিসা দেয়নি। অথচ সুদে টাকা নিয়ে তাকে আমি টাকা দিয়েছিলাম। একই রকম অভিযোগ করেন মানিকগঞ্জের মোস্তফা, রাজবাড়ীর সিরাজসহ অনেকে। এছাড়া মেডিকেল চেকআপের নামেও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ফখরুল। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা মিরাজ হোসেন বলেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি হিউম্যান রিসোর্সে আওতাধীন ওয়েলকাম মেডিক্যাল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান তিনি। দু-দুবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ করেন মিরাজ। কিন্তু তিনি ভিসা পাননি। 

তিনি বলেন, এতো মেডিক্যাল করে কী লাভ হলো। এ টাকাও তো আর ফেরত পাব না। ওয়েলকামের মালিক ফখরুলের কাছে গেলে তিনি হুমকি-ধামকি দেন। এরকম অসংখ্য শ্রমিক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। 

গত বছরের ৩১ মে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর ফখরুল ইসলাম অপর বিতর্কিত ব্যবসায়ী নূর আলীসহ কয়েকজন মিলে ভিন্ন কৌশলে সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাশীল একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর কতিপয় নেতার সঙ্গে তাদের কয়েকজনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ভাইরাল হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি রামরু নামে একটি বেসরকারি এনজিওর সঙ্গে মিলে দেশের স্বার্থ ও শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন ফখরুল।

জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী জানান, ফখরুল এখন বায়রার সভাপতি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের অনুকম্পা পেতে কথিত সিন্ডিকেট বিরোধী কথা বলছেন। অথচ তিনি সব সময়ই সিন্ডিকেটের অংশ ছিলেন এবং নিজেও সিন্ডিকেট করেছেন।

আরও পড়ুন<<>> বসুন্ধরার পাচারের টাকায় তিন মহাদেশে আট সাম্রাজ্য!

ফখরুলের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন টকশো, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে শ্রমবাজারকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার বক্তব্যগুলো তার অনুসারীরা মালয়েশিয়া, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন ছড়িয়ে দেয়ায় সম্ভাব্য নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশী শ্রমিক বিমুখ হচ্ছেন। ফখরুল ইসলাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্ববিরোধী বক্তব্য দেন। তার দাবি- ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশে কার্যকর করতে পারেননি।

সংশ্ষ্টিরা বলছেন বিষয়টি মিথ্যাচার। এফডব্লিউসিএমএস মালয়েশিয়ার জনশক্তি আমাদানি বিষয়ক সফটওয়্যার। সকল সোর্স কান্ট্রি থেকে একই নিয়মে তারা শ্রমিক নিয়ে থাকেন। ফখরুলের দাবি এফডব্লিউসিএমএস দুই দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে। যা নিলর্জ মিথ্যাচার। ফখরুল বলেন, অনেকে ভিসা নিয়ে এসেছেন, আমি নিজেও ভিসা এনেছি। সেটা অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে পাঠাতে হয়েছে। 

দুদকের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জনশক্তি রফতানি খাতের নানা অনিয়মের মাধ্যমে মোহাম্মদ ফখরুল বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর প্লটে করেছেন ১০ তলা ভবন। এ ভবনে তার হিউম্যান রিসোর্স ও ওয়েলকাম মেডিকেল সেন্টারের কার্যালয়। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় করেছেন বাড়ি। নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। ব্যাংকের রয়েছে বিপুল পরিমান স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞার ওমরপুরে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ক্রয় করেছেন তিনি। 

এসব অভিযোগের বিষয়ে ফকরুল বলেন, আমি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলি। এজন্য আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আর মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের নেমপ্লেট খুলে নেয়ার মানে বায়রা অফিসে হামলা ভাংচুর নয়। 

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়